Tuesday, November 2, 2010

আমাদের জাদুঘর, আমরাই গড়ব

১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর। ৩৮ জন যুবক স্মরণীয় এক পদযাত্রায় নেমেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে যাত্রা শুরু। সাদা কেডস পরিহিত ৩৮ জন যুবক। বৃহৎ পথের উদ্দেশে তাঁদের যাত্রা। পায়ে হাঁটার পথ যা-ই হোক না কেন, লক্ষ্যের দূরত্বটা অনেক দূরে—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসকদের বর্বরতম আগ্রাসন ও গণহত্যার কথা জানাতে হবে পৃথিবীকে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সামান্য যে ব্যানার নিয়ে পদযাত্রা, সেখানে লেখা—বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা। তবুও যে প্রেরণা তাঁরা জাগিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই পুঁজি করে আরেকটি পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করছেন এ যুগের তরুণদের প্রতিনিধিরা। ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৫ অক্টোবর, ২০১০। একাত্তরের সেই পদযাত্রাকে অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবক একটি দল তারুণ্যের পদযাত্রায় নেমেছে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ-ডলৌরা পর্যন্ত। লক্ষ্য ‘আমাদের জাদুঘর আমরাই গড়ব’।
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচায় একটি পুরোনো ভবন ভাড়া নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। বর্তমানে জাদুঘরের ব্যাপ্তি বেড়ে গেছে অনেক। এক হাজার ৪০০ স্মারক প্রদর্শিত হলো, জাদুঘরের সংগ্রহভান্ডারে জমা হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি স্মারক। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় জাদুঘর ট্রাস্টের অনুকূলে ০.৮২ একর ভূমি বরাদ্দ দেয়। এরপর থেকে আন্তর্জাতিকমানের সব সুবিধাসম্পন্ন আধুনিক একটি জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে নকশা তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থের। তরুণদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কটা অনেক বেশি আত্মিক। তাই অনেক দায়িত্ব এসে যায় তরুণদের কাছেও। এ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই স্লোগানটি নেওয়া হয়েছে, ‘আমাদের জাদুঘর, আমরাই গড়ব।’ তরুণ প্রজন্মের বিভিন্ন প্রতিনিধিদল সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে সাধ্যমতো, নিজেদের স্থান থেকে নির্বিশেষে। পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করা তরুণেরা তাঁদেরই অন্যতম। কাজী ইমরান, মন্টু বাবু সরকার, ইব্রাহীম হোসেন, মোহাম্মদ তৌহিদ হাসান, মো. নিজামউদ্দীন, এম ডি মোস্তফা, শাহাদত হোসেন, মির্জা মাহমুদ আহমেদ, সামি আহমেদ এবং এ দলটির দলনেতা শরীফ রেজা মাহমুদ জাদুঘরের জন্য অনুদান সংগ্রহের প্রচারণার উদ্দেশ্যে হেঁটে যাবেন ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত। পথে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ডলৌরার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রাবিরতি করবেন। সেখানে তাঁরা তুলে ধরবেন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কথা, অনুদানের আবেদনের কথা।
তারুণ্যের এ পদযাত্রার সঙ্গে একাত্তরের পদযাত্রাকে এক করে নেওয়ার উদ্দেশ্য—দুই প্রজন্মকে একটি মেলবন্ধনে একীভূত করা। ২০০৯ সালে আশ্চর্যভাবেই পরিচয় হয় দিলীপ নাগের সঙ্গে। যিনি একাত্তরে ‘বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রায়’ অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই খোঁজ মেলে আরও কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। ধীরে ধীরে ৩৮ জনের পরিচয়ও বেরিয়ে আসে। এ কারণে পুরো দলকে খুঁজে পাওয়ার পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে এক আশা-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ এ পদযাত্রার পথিকদের নিয়ে আয়োজন করা হয় নতুন এ পদযাত্রা। তরুণদের এ পদযাত্রা এখন সিলেট শহর ছেড়ে সুনামগঞ্জের পথে। পথিকেরা প্রায় ৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাত্রাবিরতি দিয়েছেন। অনেক অভিজ্ঞতা, বহু মূল্যবান প্রেরণা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, আত্মার টান আর ভালোবাসা নিয়ে পদযাত্রা থামবে আজ ২৯ অক্টোবর ডলৌরাতে। পুরো এ অভিযাত্রায় তাঁরা মানুষের সাড়া পেয়েছেন অনেক। কমতি ছিল না ভালোবাসার।
দলনেতা শরীফ রেজা মাহমুদ জানান, ‘পুরো অভিযাত্রায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ, এত আন্তরিক, এত স্বতঃস্ফূর্ত, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ঢাকা থেকে ডলৌরি পর্যন্ত যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়েছি, তাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিয়ে। ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর—এই প্রতিষ্ঠান আগেই বেরিয়ে গেছে, তাঁদের কাছে নিজেদের পরিবারের এমন কিছু স্মৃতির লেখা পাঠাতে বলেছে, যা একাত্তরকে আরও স্মরণীয় করে রাখবে। আমরা সেই লেখাগুলো নিয়েও আলাপ করেছি। এরপর আমরা নতুন জাদুঘরের কথা জানাই। আসলে এ জাদুঘর তো আমাদেরই। তাই বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানকে গ্রহণ করেই তৈরি হবে আমাদের জাদুঘর।’
পথ চলতে চলতে একাত্তরের পদযাত্রায় দুই পথিক অভিভূষণ চক্রবর্তী ও দীলিপ নাগের সঙ্গেও দেখা করেছেন তাঁরা। কথা হয়েছে পথের নিত্যনতুন যাওয়া-আসার মানুষের সঙ্গে। কথা হয়েছে চা-বাগানের শ্রমিক ও বেদেদের সঙ্গে, যাঁরা আজ অবধি একাত্তর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। তাই তারুণ্যের এ পদযাত্রার অর্জন অনেক—যা তারুণ্যেরই জয়গানকে প্রতিফলিত করে।
অতীতটা আসলেই কখনো হারিয়ে যায় না। অতীতই আজকের বর্তমানকে সুগঠিত করে, তাকে এনে দেয় গতি এবং দৃঢ়তা। 
 
শিখ্তী সানী | তারিখ: ২৯-১০-২০১০। 
সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-10-29/news/104998 

No comments: