সহযোদ্ধাদের চোখ কপালে উঠে গেছে। কেউ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এমনকি দীর্ঘদিনের সঙ্গী, স্ত্রী ক্রুপস্কায়া পর্যন্ত বলছেন, ‘লেনিন পাগল হয়ে গেছেন’। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা বোগদানভ তো বলেই ফেললেন, লেনিন ‘পাগলের প্রলাপ’ বকছেন। মহাকাব্যের বীরের মতো একা লেনিন তবু গোঁ ধরে আছেন, ক্ষমতা দখলের এখনই সময়। নইলে রুশ বিপ্লব হাতছাড়া হয়ে যাবে, পিছিয়ে যাবে কয়েক যুগ। কেউ শুনল না, তিনি বললেন, ‘জনগণ আমার সঙ্গে, আমি তা প্রমাণ করব।’
ওদিকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলশেভিক পার্টির প্রতিনিধিরা আসছেন। কেউ বা শত কেউ বা হাজার মাইল পেরিয়ে আসছেন বিপ্লবের নির্দেশনা নিতে। পিটার্সবার্গের সেই সোভিয়েত কংগ্রেস লেনিনের ডাকে সাড়া দিল, ঘোষণা করল, সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে চাই। এখনই। প্রমাণ হলো লেনিনই সঠিক। এত কঠিন আত্মবিশ্বাস আর এত বড় ঝুঁকি ইতিহাসে বিরল।
সেটা ছিল ৭ নভেম্বর, ১৯১৭ সাল। মহান রুশ বিপ্লবের সন্ধিক্ষণ। পার্টির ভেতর এটা ছিল তাঁর প্রথম ক্যু। দ্বিতীয় ক্যু হলো, সবচেয়ে ছোটো কিন্তু ইস্পাতের মতো কঠিন এক বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে রুশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখলের ঘটনা। লেনিনের বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ ছিল সেই দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবেরই ডাক। পৃথিবীতে কারও কলম যদি শক্তিমান হাতিয়ার হয়ে উঠে থাকে, তা লেনিনেরই কলম।
অথচ এই মানুষটিই কিছুদিন আগে বন্ধুকে লিখেছেন, ‘যদি আমাকে ওরা মেরে ফেলে, তাহলে রাষ্ট্র ও বিপ্লব বিষয়ে আমার সবুজ রংয়ের নোট খাতাটি তোমরা প্রকাশ কোরো।’ এপ্রিল থিসিস যদি বিপ্লবের ইশতেহার হয়ে থাকে, তাহলে তার রূপরেখা হলো এই বই।
হাজার বছর আগের এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, ‘বউ শিশুটাকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে, ঘাসগুলো হবে সবুজ।’ বিপ্লব যেন এক বৃষ্টি, যাতে সবকিছু ভিজে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এই স্বপ্ন মানুষ দেখে এসেছে। রুশ বিপ্লব সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিল। সত্যিই ১৯১৭ সালের রাশিয়ায় মনে হচ্ছিল সব কিছুই সম্ভব। মানুষ সব পারে। পারে শোষণের জিঞ্জির ছিঁড়তে, পারে এই নিষ্ঠুর জগৎটাকে খোলনোলচেসহ বদলে দিতে। এক বিরাট আশাবাদের জন্ম দিয়েছিল রাশিয়ার খেটে খাওয়া মানুষ। তারা ঘোষণা করল, কোনো শ্রেণী থাকবে না, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অসম্ভব হবে। রচিত হবে নতুন মানবজমিন, নতুন মানবচরিত। মানুষ হবে অমৃতের সন্তান।
পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল এই ঘোষণায়। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার পরাধীন জাতিগুলো চমকে উঠেছিল এই ডাকে। বিশ্বের শ্রমিকেরা হয়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাসী। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এই প্রথম পরাজয়ের তিতা স্বাদ পেয়েছিল।
যে মানুষটি এই বিপ্লবের কারিগর, নদীর নামে নাম ছিল তাঁর। দাদা ছিলেন ভূমিদাস, বাবা শিক্ষক, তিনি তরুণ বয়স থেকেই বিপ্লবী। পুরো নাম ভ্লাদিমির এলিচ লেনিন। বন্ধুরা ডাকত ইভান ইলিচ বলে।
অথচ ১৯১৭ সালের প্রথমে তিনি ইউরোপে প্রায় অপরিচিত এক নির্বাসিত বিপ্লবী। রুশ বিপ্লবের আরেক কিংবদন্তি লিও ট্রটস্কি লিখেছেন, ‘লন্ডনে এক ভোরে যখন তাঁকে দেখি, তাঁর কপালের রেখায়, গভীর চোখের চাহনিতে আর দৃঢ় ঠোঁটের ভাঁজে আমি পাঠ করেছিলাম রাশিয়ার ভবিষ্যৎ।’ রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি মনে করতেন ‘সময়ের থেকে বহুদূর অবধি দেখতে পেতেন লেনিন।’
আজ আমরাও বহুদূর থেকে ১৯১৭ সালকে দেখছি। বিপ্লবের ৭৩ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল। লেনিন ও তাঁর অনুসারীদের মৃত্যুর পর থেকেই অনেক ভুল আর আপসে ক্ষয়ে যাচ্ছিল নতুন সমাজের নবীন শেকড়। গৃহযুদ্ধ আর বিশ্বযুদ্ধে বিপ্লবী বলশেভিকদের বেশির ভাগই মরে গিয়েছিল। স্ট্যালিনের ভুলেও মারা পড়েন অনেক খাঁটি শ্রমিক। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও আমলারা ক্ষমতার সব আসনে বসে পড়েছিল। রাশিয়ার মানুষ বাঘের ছাল পরা সেই শেয়ালের শাসন মানেনি। উল্টে ফেলে দিয়েছিল, যেভাবে তারা উল্টে দিয়েছিল জারের মসনদ। কিন্তু আজও
লেনিন তাদের প্রিয় নেতা। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা মহানায়কদের মধ্যেও আছেন মহামতি লেনিন। তাঁকে দেখে এক শ্রমিক বলেছিল, ‘লেনিন, সত্যের মতো কঠিন ও সরল’। রুশ বিপ্লবও ছিল তেমনই এক সরল ও কঠিন বিজয়।
ব্রিটিশ নাট্যকার ব্যাট্রল্ড ব্রেখট রুশ লেখেন, ‘তখন থেকেই পৃথিবীতে আশা ফিরে এল।’ পৃথিবীর হেন দেশ নেই যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠেনি এবংনিষিদ্ধ হয়নি। জগতের লাঞ্ছিত-হতভাগ্য মানুষ এই পার্টিকেই মনে করতে থাকে তাদের মুক্তির আশ্রয়।
দেশে দেশে বিপ্লবের পর বিপ্লব ঘটতে থাকে পরের দশকগুলোতে। চীন, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে মুক্তির খবর আসতে থাকে। বিপ্লবের ভয়ে বড় বড় পুঁজিবাদী দেশে শোষণ কিছুটা কমে। অনেকের মনেই বিশ্বাস আসে, মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ মানুষেরই হাতে। রুশ বিপ্লবই হলো ইতিহাসের প্রথম পরিকল্পিতভাবে, সংগঠিত জনগণের শক্তিতে শোষণের দুর্গ ভাঙার শিক্ষা।
গত শতকের ষাটের দশক ছিল সে রকমই এক উথালপাতাল সময়। বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানি স্বৈরশাসন চলেছে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কিন্তু গোপনে তারা কাজ করে চলছে তেভাগা আন্দোলনে, চল্লিশের খাদ্য আন্দোলনে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, তেষট্টির ছাত্র আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেরও প্রধান শক্তি তারা। ইতিহাসের ঢেউ ওঠা-পড়ার সে রকমই এক সময়ের গল্প:
গোপন মিটিং বসেছে যশোরের এক দরিদ্র কমিউনিস্টের বাড়িতে। গোপনে হাতে হাতে চিরকুট পাঠিয়ে খবর দেওয়া হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে কমরেডরা এসেছেন। বাড়ির একটি ঘরে বৈঠক চলল সারা দিন। সন্ধ্যার দিকে যখন সবার অন্ধকারে লুকিয়ে যাওয়ার সময়, তখন হঠাৎ ভেতর-বাড়ি থেকে বুকচাপা ডুকরানো কান্নার শব্দ এল যেন।
‘কে কাঁদছে?’, বাড়ির কর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন একজন।
তিনি চুপ। তাঁর মাথা নিচু হতে হতে বুকের সঙ্গে লেগে গেল। আবারও প্রশ্ন: কী হয়েছে, বলুন কমরেড? তিনি তবু নীরব, কেবল গাল বেয়ে অশ্রুর রেখা দেখা যায়। শেষে একজন উঠে ঢুকে পড়লেন ভেতর-বাড়িতে। পিছু পিছু অন্যরাও। তাঁরা যা দেখলেন, তা অবিশ্বাস্য। কমিউনিস্টও তো মানুষ। তাঁরও স্ত্রী-সন্তান ছিল। বড় ছেলেটা আগের রাতে মারা গেছে। পার্টির মিটিং হবে বলে মৃত্যুর খবরটা জানতে দেননি কাউকে। স্ত্রীকে বলে রেখেছিলেন, যেন না কাঁদেন, যেন কেউ টের না পায়। তারপর নিজে এসে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সভা করেছেন। কেবল সন্ধ্যার দিকে সেই মানুষটি, যিনি মা, যিনি নারী, যিনি শোকতপ্তা; আর পারেননি, কেঁদে উঠেছিলেন।
রুশ বিপ্লব বিশ্বময় এ রকম অগণিত মানুষ সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের অবদানে পৃথিবী কিছুটা এগিয়েছিল। তাঁরা এ রকম পারতেন, যেমন পারতেন তাঁদের সবার গুরু কার্ল মার্ক্সও। অভাবে-অনটনে আর বিনা চিকিৎসায় তাঁরও একমাত্র শিশুপুত্র অকালে মরে গিয়েছিল। তিনিও সন্তানদের দাফনের টাকা জোগাড় করতে না পারা এক ব্যর্থ বাবা। কিন্তু আজও যেখানেই অন্যায়, যেখানেই মানুষের উঠে দাঁড়ানোর স্পর্ধা, যেখানেই মানুষের মতো বাঁচার সংগ্রাম চলছে বা চলবে, সেখানেই উঠে আসবে মার্ক্সের নাম, লেনিনের নাম আর রুশ বিপ্লবের সেই ডাক—জাগো লড়ো, বাঁচো।
মুল সুত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-11-08/news/107472
No comments:
Post a Comment