Tuesday, November 2, 2010

তাঁকে কেউ ভুলবে না (বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান)

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জোরদার হয়। আর পাকিস্তান সরকার যখন এ যুদ্ধকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশাল একটি বাহিনী এসে যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। ফলে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১১টি সেক্টরে ভাগ হয়ে যুদ্ধ হলেও এগুলো ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ১১টি সেক্টরের মধ্যে ৪ নম্বর সেক্টর মেজর জেনারেল সি আর দত্তের অধীনে ছিল ত্রিপুরার কমলপুর সাব-সেক্টর। এ সেক্টরে একজন সাব-সেক্টর সহ-অধিনায়ক ছিলেন কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) সাজ্জাদুর রহমান। তাঁর স্মৃতিচারণায় জানা যায়, ২৪ অক্টোবর রাতের শেষ দিক থেকে ২৮ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই সীমান্তে ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) ফাঁড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলে। ধলই সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্লাটুনের অ্যাসল্ট অফিসার ছিলেন মেজর (অব.) কাইয়ুম চৌধুরী। আর সিপাহি হামিদুর রহমান ছিলেন মেজর কাইয়ুম চৌধুরীর রানার। টানা চার দিনেও পাকিস্তানি বাহিনীকে যখন পিছু হটানো যাচ্ছিল না, তখন নিজ ইচ্ছায় সিপাহি হামিদুর রহমান ধলই ইপিআর ক্যাম্পে এসে গ্রেনেড মেরে পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করার কঠিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২৮ অক্টোবর ঘন কুয়াশা ও প্রবল গুলিবর্ষণের মধ্যে ভোররাত চারটায় প্রায় আধা কিলোমিটার গ্রেনেড হাতে ক্রলিং করে সিপাহি হামিদুর রহমান ধলই ইপিআর ক্যাম্পে পাকিস্তানি শক্তিশালী অবস্থানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালান। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ফেরার সময় পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের একটি গুলি এসে বুকে লাগে সিপাহি হামিদুর রহমানের। হঠাৎ করে একটু নীরবতা। পরক্ষণে সহ-মুক্তিযোদ্ধারা এসে খুঁজে বের করেন শ্রেষ্ঠ বীর সিপাহি হামিদুর রহমানের লাশ। লাশ উদ্ধার করে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ত্রিপুরার আমবাসায় নিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়।
বিশ্বের এমন কোনো দেশের ইতিহাস নেই যে, এত অল্প সময় যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভিয়েতনামের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলেছে ৩১ বছর। দেশমাতৃকয়াকে শত্রুমুক্ত করতে অতি অল্প সময়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন। একেবারে মুখোমুখি অবস্থান করে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মাত্র নয় মাসে শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে সাতজনকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয় বাংলাদেশ সরকার। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীর ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ঝিনাইদহ জেলার গর্ব সিপাহি হামিদুর রহমান।
দেশ স্বাধীনের ৩৪ বছর পর গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কমলগঞ্জের সাংবাদিকেরা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য লিখিত আবেদন করেছিলেন তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে। ধলই সীমান্তে, যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান শহীদ হয়েছিলেন, সেখানেই সাইফুর রহমানের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘ যোগাযোগের পর অবশেষে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের মরদেহ দেশে এসেছে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে। তবে সিপাহি হামিদুর রহমানের সহযোদ্ধা কমলগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের জোর দাবি ছিল, খুব সহজে ধলই সীমান্ত দিয়ে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে নিয়ে এলে তাঁর নামের স্মৃতিসৌধ এলাকায় শেষবারের মতো সম্মান জানাতে পারতেন তাঁরা। সরকারি উদ্যোগে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে শ্রেষ্ঠ বীর সিপাহি হামিদুর রহমানের মরদেহ দেশে এনে ঢাকায় সমাহিত করা হয়েছে, তাতে সবাই খুশি।
মুজিবুর রহমান | তারিখ: ২৮-১০-২০১০
সুত্র:   http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-10-28/news/104768

No comments: