Tuesday, November 2, 2010

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের ফসিল (স্যু কাহিনী)

নামটা খুব সাধারণ- 'স্যু'। কিন্তু এ নামের পিছনে
রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় আর এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি
গবেষণালব্ধ প্রাণী ডাইনোসরের নাম। এই স্যু হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টি রেক্সের নমুনার ডাক নাম। এফএমএনএইচ পি আর ২০৮১ নামের এই টাইরানোসোরাস রেক্স বা ডাইনোসরের ফসিলটি এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সংরক্ষিত ডাইনোসরের নমুনা।



ডাইনোসর পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী। এই প্রভাবশালী মেরুদণ্ডী প্রাণীটি প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে। ডাইনোসরের সৃষ্টি হয়েছিল আনুমানিক ২৩০ মিলিয়ন বছর আগে। ঈৎবঃধপবড়ঁং যুগের শেষে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে একটি বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডাইনোসরকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেয়। তাদের একটি শ্রেণীই কেবল বর্তমান যুগ পর্যন্ত টিকে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জীবের শ্রেণীবিন্যাসের জন্য ব্যবহৃত সাধারণ পদ্ধতি ক্ল্যাডিস্পি-এর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে পাখিরাও এক ধরনের ডাইনোসর। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে পাখিরা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই এখন ডাইনোসর বলতে শুধুমাত্র উড়তে অক্ষম বিশালাকারের প্রাণীকে বুঝানো হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ডাইনোসরের প্রথম জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে পর্বতগাত্র বা শিলায় আটকে থাকা ডাইনোসরের কঙ্কাল পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ডাইনোসর বর্তমান বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে এবং সব বয়সীদের কাছেই বিশেষ আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সর্বাধিক বিক্রীত বই কিংবা প্রচুর কাটতি পাওয়া চলচ্চিত্রে ডাইনোসর প্রসঙ্গ এসেছে। আর এ সংক্রান্ত নতুন যে কোনো আবিষ্কার মিডিয়াতে বিশেষভাবে সম্প্রচার করা হয়। ডাইনোসরের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ফসিলটি ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেইথ শহরের পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে ডাকোটার চেনি নদীর তীর থেকে এটি আবিষ্কৃত হয়। এখানে আগ থেকেই ডাইনোসরের একাধিক ফসিলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এর আবিষ্কর্তা স্যু হেন্ড্রিক্স এ কারণে এসেছিলেন ব্ল্যাক হিলস ইনস্টিটিউট অব জিওলজিক্যাল রিসার্চের পক্ষ থেকে। এখানে এসে খননকার্য চালাতে গিয়ে প্রায় ৬০ ফুট গভীর একটা গর্তে কিছু হাড় দেখতে পান। প্রথমে এই হাড়ের টুকরোগুলো দেখে মনে হয়েছিল যে, হয়তো ওপর থেকে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া গর্তের তলা থেকে প্রায় সাত ফুট উপরের দেওয়ালে তিনটি মেরুদণ্ডের হাড় আটকে থাকতে দেখা যায়। এরপর স্যু হেন্ড্রিক্স হাড়গুলোর আকৃতি দেখে এগুলোকে কোনো একটা মাংশাসী প্রাণীর হাড় বলে ধারণা করলেন। তিনি ও তার দল বুঝতে পারল এটা কোনো টি রেক্স এর জীবাশ্ম হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো ওই জায়গার মালিককে নিয়ে। স্যু হেন্ড্রিক্স যে জমিতে এই অতিকায় জীবাশ্মের সন্ধান পান এর মালিক ছিলেন স্থানীয় নেটিভ আমেরিকান মরিস উইলিয়ামস। তাই হেন্ড্রিক্সের প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পিটার লারসেন উইলিয়ামসকে তার জমিতে পাওয়া ফসিলের মূল্য হিসেবে তাকে পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে দিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ফসিলের বাণিজ্যিক সরবরাহকারী হিসেবে পিটার লারসেন একটি সুপরিচিত নাম। এবার শুরু হলো দ্রুত এবং অক্ষত অবস্থায় ফসিল উদ্ধারের অভিযান। লারসেনের প্রতিষ্ঠান থেকে সেজন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। প্রায় ৩০ ফুট দীর্ঘ ও ২৯ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট এলাকা ২৫ ফুট গভীর পর্যন্ত খোঁড়াখুড়ি করতে ১৭ দিন সময় লেগে গেল। কিন্তু ১৯৯২ সালের ২৪ মে জিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষক ও কর্মচারীরা যখন সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির সাহায্যে খুঁজে পাওয়া ডাইনোসরের জীবাশ্মের গায়ে লেগে থাকা পাথর ও মাটি পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত তখনই ওয়ারেন্ট নিয়ে হাজির ফেডারেল সরকারের এজেন্ট। সরকার স্যু-এর ফসিল যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই সিজ করে নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্যসব নেটিভ আমেরিকানদের মতো উইলিয়ামসকে তার জমির জন্য কোনো প্রকার ট্যাক্স দিতে না হলেও এ জমি বিক্রি বা লিজ দেওয়ার আগে অবশ্যই সরকারের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল। অথচ উইলিয়ামস তা না করেই এখান থেকে জীবাশ্ম উদ্ধারের কাজ চালাচ্ছেন। ফলে থেমে গেল স্যু'র উদ্ধার কাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, ওই জমির মালিকই হবেন ওখানে প্রাপ্ত জীবাশ্মের মালিক। ফলে ফসিল বিক্রির বিষয়ে উইলিয়ামসের আর কোনো বাধা রইল না। এরও দু'বছর পর উইলিয়ামস স্যু-এর ফসিল নিলামে বিক্রির জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি সোথবি-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৯৬ সালে তারা ফসিলগুলোর উপযুক্ত ক্রেতা খুঁজে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ছবি, ক্যাটালগ ও ইনভেনটরি তৈরি করে ওটাকে নিউইয়র্ক নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির কর্তৃপক্ষ। কেননা, এ যাবৎ ডাইনোসর যুগের যতো ফসিল পাওয়া গেছে, তার মধ্যে স্যু-এর ফসিলই পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া গেছে। শেষ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন ডলারের নিলামের মাধ্যমে শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি এটি কিনে নেয়। প্রায় ৪০ ফুট লম্বা ও ১৩ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট স্যু তার জীবদ্দশায় প্রায় ৬-৮ টন ওজনের ছিল বলে মনে করা হয়। মিউজিয়ামে রাখা মোট ২২টি জীবাশ্মের মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। পশ্চিম আমেরিকার টি রেক্স অঞ্চল পাওয়া ডাইনোসরের ফসিলগুলোর মধ্যে একমাত্র স্যু-এরই ৯০ শতাংশের মতো হাড় আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। আকারের বিশালতা ও পূর্ণাঙ্গতার কারণেই এই ফসিলের আবিষ্কারের মাধ্যমে আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছরেরও বেশি সময় আগে বিস্তৃত ক্রিটেসিয়াস যুগের অনেক রহস্য উন্মোচন হতে যাচ্ছে। আসলে এটা এমন একটা সময় ছিল যখন ডাইনোসর যুগের শেষ পর্যায়ে ব্যাপক আকারে ডাইনোসর বিলুপ্তির ঠিক আগে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের নতুন নতুন প্রজাতির দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে।

অন্ধকারের ভেতর থেকে মাথার খুলিটা যেন গর্জন করছে। একেকটি হাড় যেন মোটা গাছের গুঁড়ির মতো। পুরো হাড়ের সুচালো আকৃতির মুখ থেকে তলোয়ারের মতো দাঁতগুলো এমনভাবে বেরিয়ে আছে যে এটাকে দেখলে যে কারোরই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হবে। ডায়নোসর স্যুর ফসিলের অনুকরণে নির্মিত অ্যানিমেটেড খুলিটির দিকে তাকালে যে কেউই আঁৎকে উঠবেন। আর যে ফসিলটির অনুকরণে এই ছবি বানানো হয়েছে সেটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে। আজ থেকে প্রায় ছয় কোটি সত্তর লাখ বছর আগের এই টাইরানোসোরাস রেক্সটি বিশ্বজুড়ে স্যু নামে পরিচিত। এ প্রজাতির জীবাশ্মের প্রথম আবিষ্কারক স্যু হেন্ড্রিকসন-এর নাম থেকেই এ নামের উৎপত্তি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী এই স্যু বা টাইরানোসোরাস-এর সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে সুদীর্ঘকাল এদের টিকে থাকা এবং বিলুপ্ত হওয়ার পিছনের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে। 

রণক ইকরাম । সুত্র: http://www.bangladesh-pratidin.com/?view=details&type=pratidin&pub_no=189&cat_id=3&menu_id=16&news_type_id=1&index=0

No comments: