Monday, November 1, 2010

আপনগাঁওয়ে জাদুকর

সকাল। ঠিক সকাল বলা যাবে না। ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁইছুঁই। পূর্ব আকাশে দিনের নতুন সূর্য তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তখনো অফিসগামী মানুষগুলো ছুটে চলছে নানা বাহনে চেপে। আমাদেরও যেতে হবে। তবে রাজধানীর ব্যস্ত অফিসপাড়ায় নয়, নয় কোনো ব্যস্ত এলাকায়। আপনগাঁওয়ে চলেছি আমরা। সেখানকার মাদকাসক্তি পুনর্বাসন নিবাসে। আপনগাঁও শব্দটি শুনলে মনটা জানি কেমন হয়ে যায়। নিজের জন্মভূমি গ্রামটির কথা মনে পড়ে। কত কালের যেন পরিচিত। সফরসঙ্গী চারজন। জাদুকর উলফৎ কবীর, আলোকচিত্রী রানা, গাড়ির চালক এবং আমি। রাজধানী ঢাকার যানজট পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে আপনগাঁওয়ের দিকে। সবার মধ্যে কেমন ফুরফুরে ভাব। সেই অনুভূতিকে আরও বেগবান করে শরতের প্রকৃতি। নীল আকাশ, সাদা মেঘ ভেসে চলে এলোমেলোভাবে। গাবতলী পার হওয়ার পরই শরৎ যেন তার আসল রূপের দরজা মেলে দিয়েছে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি কাশফুল। বাতাস খেলে যায় সেই কাশবনের মাঝে। এদিককার আকাশে সাদা মেঘ আরও দুরন্ত। মেঘের সাদা আর শরতের সাদা আমাদের চোখে মুগ্ধতা এঁকে দেয়। সাদা কাশফুল আর রাস্তার দুই পাশের সবুজ গাছগাছালির মাঝ দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটে চলে আমাদের গাড়ি। যতই এগোই ততই চোখ জুড়িয়ে যায় প্রকৃতির অপরূপ রূপে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশের হেমায়েতপুরের কাছে পৌঁছাতেই রাস্তা পরিবর্তন করতে হলো। মহাসড়ক ছেড়ে গাড়ি চলতে শুরু করল ছোট একটা রাস্তা ধরে। একটু এগোলেই শহীদ রফিক সেতু। মানিকগঞ্জের রাস্তা বাজারের কাছাকাছি যাওয়ার পরই চোখ পড়ল আপনগাঁওয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা। দিকনির্দেশনার নির্দেশ অনুযায়ী এগোতেই মাটির রাস্তা। দেশের অন্য সব গ্রামের রাস্তার মতোই এই রাস্তা। রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে সেটির অবস্থা বেজায় খারাপ। মাটির রাস্তার গর্তে পানি জমে আছে। বেশ সতর্কতার মধ্যে চলতে থাকে আমাদের গাড়ি। মাঝেমধ্যে রাস্তার অবস্থা খুব বেশি শোচনীয় হওয়ায় গাড়ি থেকে নামতে হচ্ছিল আমাদের। গাড়ি ঠেলতে হচ্ছিল ‘হেঁইয়ো হেঁইয়ো’ বলে। এভাবে চলতে চলতে একসময় গন্তব্যে পৌঁছাই আমরা।
আপনগাঁওয়ের কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল কিছুসংখ্যক তরুণ। রাস্তায় মাটি তুলছেন তাঁরা। কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। ‘আমাদের আপনগাঁওয়ের ১৬ বছর পূর্তি হবে কাল। অনেক অতিথি আসবেন সেখানে। তাই আমাদের আপনগাঁওয়ের রাস্তা আমরা সবাই মিলে ঠিক করছি।’ রাস্তা ঠিক করার কারণটি সমস্বরে ব্যাখ্যা করলেন সেই তরুণেরা। তাঁদের প্রিয় আপনগাঁওয়ের ১৬ বছর পূর্তি। কত কত লোক আসবে সেই অনুষ্ঠানে। শুধু রাস্তা ঠিক করাই নয়। অনুষ্ঠান সফল করার জন্য সবকিছুই তাঁরা নিজেরা মিলেই করছেন। অনুষ্ঠানের মঞ্চ ঠিক করা, পুরো আপনগাঁও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাসহ বিভিন্ন কাজ। সবাই যার যার মতো দায়িত্বে রত। আমাদের যাওয়ার মূল কারণ, মাদকাসক্ত অবস্থা থেকে পুনর্বাসনের জন্য আপনগাঁওয়ে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের জাদু দেখানো। তাদের কিছু সময়ের জন্য হলেও আনন্দ দেওয়া।
শিশুদের ক্লাস ছিল। তাই আমাদের খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। আপনগাঁও পরিচালনা করে থাকে ‘আপন’ নামের একটি সংস্থা। এর নির্বাহী পরিচালক ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল একসময় আমাদের নিয়ে যান শিশুদের মধ্যে। জাদুকর উলফৎ কবীরকে দেখে শিশুদের আনন্দ ধরে না। বড়দের মুখেও আনন্দের ঝিলিক। জাদুকর উলফৎ তাঁর জাদুর বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে হাজির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। ঠিক সে সময়টা শিশুদের নাশতার সময় ছিল। তাই নাশতার বিরতির জন্যও জাদুকরকে বসে থাকতে হলো আরও কিছুক্ষণ। কিন্তু শিশুদের দেখা গেল যেমনকে তেমন। নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ নেই! কারণ, নাশতা খেতে উঠলেই যে বসার জায়গাটি ছেড়ে দিতে হবে। পরে তা ফিরে পাওয়া যাবে, সেটির নিশ্চয়তা কী? অনেক বোঝানোর পরও কাজ হলো না কিছুই। বেশির ভাগ শিশুই নাশতা না খেয়ে বসে রইল তুমুল আগ্রহ নিয়ে। সবার চোখেমুখেই অপেক্ষা। জাদুকর কখন তাঁর ভোজবাজি দেখাবেন! তাদের চাহনিতে হাজারো প্রশ্ন আর রাজ্যের বিস্ময়। একটুখানি ভালোবাসা আর বিনোদনের কাঙাল তারা। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বোঝা যায়, প্রতিটি ক্ষণ ওরা ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়।
একসময় নাশতার বিরতি শেষ হয়ে আসে। ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর শুরু হয় জাদু। জাদুকরের হাতে সাদা একটি কাগজ। কাগজে কোনো কালো দাগ নেই। দাগ না থাকার কারণে কাগজগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে। কাগজে লেখা যাচ্ছে। কিন্তু জাদুকর যে কী এক জাদুই করলেন, তাতে করে চোখের পলকেই সাদা কাগজ ভরে গেল কালো কালো দাগে! এবার জাদুকর সবার হাত দেখতে চাইল। সবাই হাতে দেখাল। কিন্তু জাদুকর, মানে শিশুদের ম্যাজিক আঙ্কেল, কারও হাতে কোনো ময়লা দেখতে পেলেন না। সবার হাত পরিষ্কার। জাদুকর বললেন, ‘খালি চোখে কাগজের কালো দাগগুলো তো দেখা যায়নি। এরপর যখন জাদু করলাম, তখন কিন্তু তা কালো দাগে ভরে গিয়েছিল। তেমনি খালি চোখে হাতে ময়লা দেখা না গেলেও, হাতের মধ্যে অনেক ময়লা লুকিয়ে থাকে। ময়লা হাতে কোনো কিছু খেলে অনেক রোগ হতে পারে। তাই খাওয়ার আগে সব সময় ভালো করে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।’ জাদু শেষ হওয়ার সঙ্গে তুমুল হাততালি। আরেকটি নতুন জাদু দেখার আবদার। জাদুকর উলফৎ কবীর তাদের কথা তো ফেলতে পারেন না। একটার পর একটা জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করলেন অসহায় শিশুগুলোকে। একটা জাদু শেষ হয় আর শিশুদের কলরবে মুখর হয় চারপাশ। এমন আনন্দ তো আসলে প্রতিদিনই আসে না ওদের জীবনে! জাদুকর উলফৎ কবীর বললেন, ‘জাদু দেখিয়েই আমার আনন্দ। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসিই আমার জাদুর সার্থকতা।’ উলফৎ কবীর বললেন, ‘শিশুদের কাছ থেকে পাওয়া এই ভালোবাসা আমার শক্তি। আর এই শক্তি নিয়ে সারা দেশ ঘুরে জাদু দেখাই। শুধু আপনগাঁওয়েই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিশুদের জাদু দেখানো আর জাদুর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তোলাটাই আমার নেশা। এখন এটা আমার পেশাও।’

তারিকুর রহমান খান | তারিখ: ৩১-১০-২০১০
সুত্র: প্রথম আলো।   http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-10-31/news/105690

No comments: