Monday, October 4, 2010

 নায়কের প্রত্যাবর্তন (মুক্তিযুদ্ধের নায়ক)

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য অস্ত্র নিয়ে রাজশাহীর বিড়ালদহ গ্রামে অসামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ইপিআরের সদস্যরা। সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া ইপিআর সদস্য দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩৬ বছর ধরে খুঁজেছে রাজশাহীর লোকজন। অবশেষে তাঁদের একজনকে খুঁজে পাওয়ার গল্প নিয়ে লেখা—

কেমন হবে, এখন হঠাত্ একদিন যদি শফি ইমাম রুমী ফিরে আসেন? ফিরে এসে আমাদের বলতে শুরু করেন একাত্তরের দিনগুলোর কথা! কেমন হবে, যদি আমাদের মধ্যে হঠাত্ ফিরে আসেন একাত্তরে হারিয়ে যাওয়া অন্য কোনো নায়ক?
এসব প্রশ্নের জবাব হয় না। কারণ, হারিয়ে যাওয়া নায়কেরা আর ফিরে আসেন না। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, তাঁদের ফেরার। কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যি হয় না। এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়মেরও যে ব্যতিক্রম আছে। এই ব্যতিক্রমকে প্রমাণ করতেই মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া এক বীর ফিরে আসেন সাড়ে তিন দশক পার করে।
৩৬ বছর পর আবার যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় ফিরে আসেন এক মুক্তিযোদ্ধা। ফিরে আসেন লস্কর সিরাজউদ্দিন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহীর বিড়ালদহ গ্রামে অসামান্য এক প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন সিরাজউদ্দিন। একাত্তরের পর আরও অনেকের মতো ‘হারিয়ে গেছেন’ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে আবার ফিরে এসেছেন সেই নায়ক। সিরাজউদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার কাজটা করেছেন এই প্রজন্মের তরুণেরা।
সিরাজউদ্দিনের ফেরার গল্পটা শুরু করতে হবে সেই একাত্তর থেকেই। নায়েক সুবেদার পদে চাকরি করতেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর)। একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে সিরাজউদ্দিন ছিলেন চারটি বিওপির (বর্ডার অপারেশন পোস্ট) দায়িত্বে। মার্চের মাঝামাঝি এসেই বুঝতে পারছিলেন, একটা ঝড় আসছে।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বুঝতে পেরে ২৭ মার্চ তিনি গ্রেপ্তার করে ফেললেন বিওপিগুলোর অবাঙালি সৈনিকদের। তাদের অস্ত্র রেখে দিয়ে রাজশাহীর চারঘাট থানা হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর সঙ্গী বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে শুরু করলেন মুক্তির লড়াই।
যুদ্ধের প্রথম বিজয়টা সিরাজউদ্দিনদেরই হয়েছিল। ৪ এপ্রিল রাতে রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে আটকে ফেলে। এ ঘটনার ফলে কার্যত রাজশাহী শহর পাকিস্তানের দখলমুক্ত হয়ে যায়।
কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তো তখনো হার মানেনি। খবর এসে যায়, অবরুদ্ধ বাহিনীকে উদ্ধার করতে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি বিশাল সেনাবহর আসছে। রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দিয়ে তারা নগরবাড়ী ঘাট অতিক্রম করেছে।
খবরটি বিচলিত করে তোলে রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তানি বাহিনীকে রাজশাহীতে ঢোকার আগেই ঠেকানোর পরিকল্পনা করা হয়। সেই উদ্দেশ্যে লস্কর সিরাজউদ্দিন, সুবেদার মোবাশ্বেরসহ ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাবনার নগরবাড়ীতে পাঠানো হয়।
পাবনায় গিয়ে সিরাজউদ্দিন-মোবাশ্বেররা বুঝতে পারেন, পাকিস্তানি বিশাল এই সেনাবাহিনীকে ঠেকানো সহজ কম্ম নয়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পিছিয়ে আসেন সিরাজউদ্দিন ও তাঁর দল।
কিন্তু পেছানোর জন্য তো যুদ্ধে যাননি তাঁরা! বিকল্প উপায় বেছে নিলেন সিরাজউদ্দিন-মোবাশ্বেররা। ৭ এপ্রিল থেকে তাঁরা শুরু করলেন ‘হিট অ্যান্ড রান’। চোরাগোপ্তা আক্রমণ করেন আর পেছান। এই করতে করতে ১২ এপ্রিল পুঠিয়ার বিড়ালদহে এক লোহার সাঁকোর কাছে পৌঁছে গেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সিদ্ধান্ত হলো, এখানেই চূড়ান্ত প্রতিরোধ করতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীকে। এই সাঁকো পার হয়ে আর এগোতে দেওয়া হবে না তাদের।
শুরু হলো প্রতিরোধপর্ব। রাস্তা কেটে ফেলা হলো। তৈরি করা হলো পরিখা। মহাসড়ককে মাঝে রেখে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিরোধ-বলয় তৈরি করা হয়। সকাল ১০-১১টা নাগাদ শুরু হয়ে গেল প্রবল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা বড়ই দুর্বল পক্ষ। কিন্তু অস্ত্রের বিচারে নয়, মনের বিচারে তাঁরা রুখে দাঁড়ালেন।
বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অসম শক্তির এই লড়াই চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুমান, সেদিন শতাধিক পাকিস্তানি সৈনিক মারা পড়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হয়ে আসে প্রতিরোধ। ফুরিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ। সারা দিনের এই প্রতিরোধযুদ্ধে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
নিরুপায় হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাশের গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। গ্রামবাসী প্রাণপণে রক্ষা করার চেষ্টা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যার কাছে যা কিছু ছিল, তা নিয়েই ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয় পাকিস্তানিদের। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না।
প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে এলে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। শুরু হয় নৃশংস প্রতিশোধপর্ব। এতে শহীদ হন ৭১ জন নিরীহ গ্রামবাসী। দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত একরকম নিষ্ফলই হয়ে যায় ১২ এপ্রিলের এই অসামান্য প্রতিরোধপর্ব।
প্রতিরোধ আপাতত নিষ্ফল হয়ে যায়, কিন্তু মানুষের মন থেকে মুছে যায় না সিরাজউদ্দিন-মোবাশ্বেরের নাম। চিরকালের নায়ক হয়ে ওঠেন এই দুই মুক্তিযোদ্ধা। এপ্রিল থেকে সময় গড়িয়ে ডিসেম্বর আসে। সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানিরা। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নতুন কোনো ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে চলে যান সিরাজউদ্দিন-মোবাশ্বের।
সেই চলে যাওয়াই যেন ‘হারিয়ে যাওয়া’ হয়ে যায়। যুদ্ধের সময়ে কে কার ঠিকানা লিখে রাখে! তাই সিরাজউদ্দিন-মোবাশ্বেরদের খবরও আর পান না রাজশাহীর লোকজন। এখানকার তরুণেরা শুধু সেই গল্প শুনে বড় হয়ে ওঠেন। নায়ককে আর দেখা হয় না। অবশেষে ৩৬ বছর পর সেই নায়কদের খুঁজে বের করার একটা উদ্যোগ নেন নওশাদ আলীর মতো কিছু মানুষ।
এলাকার কিছু মানুষ ‘বিড়ালদহ প্রতিরোধযুদ্ধ স্মরণ সংসদ’ নামের একটা সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, পেশায় চিকিত্সক নওশাদ আলী ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই প্রথম আলোর চিঠিপত্র কলামে একটি চিঠি লেখেন।
চিঠিতে লস্কর সিরাজউদ্দিন ও মোবাশ্বের আলীকে আহ্বান জানানো হয় বেঁচে থাকলে সাড়া দেওয়ার জন্য। এই চিঠিতে কাজ হবে—এমন আশা খুব বেশি লোকের ছিল না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিঠি প্রকাশের ১৫ দিন পর নওশাদ আলীর ঠিকানায় আসে একটি চিঠি।
নড়াইল থেকে চিঠিটি পাঠিয়েছেন সুবেদার লস্কর সিরাজউদ্দিন! আনন্দে মেতে ওঠেন বিড়ালদহের মানুষ। অবশেষে অন্তত একজন নায়ককে খুঁজে পাওয়া গেল।
এক আত্মীয় পত্রিকায় চিঠিটি পড়ে লস্কর সিরাজের কাছে নিয়ে যান। চিঠি পেয়েই লস্কর সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন নওশাদ আলী। তাঁরা তাঁকে ২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। সেদিন ঢাকা থেকে তাঁকে বিশেষ গাড়িতে করে বিড়ালদহে নিয়ে আসা হয়। যে মাটিকে মুক্ত করার জন্য একদিন তিনি জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন, ৩৬ বছর পর বীরের বেশে তিনি সেই মাটিতে পদার্পণ করেন।
সেদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম জাহাঙ্গীর। এত দিন পর সেই যুদ্ধের নায়ককে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন জাহাঙ্গীর। কেঁদে ফেলেন উপস্থিত লোকজন। লস্কর সিরাজউদ্দিনকে সেদিন বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকও। এই সংবর্ধনার ভেতর দিয়ে শুরু হয় আরেক নৈকট্য।
২০০৯ সালেও একই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সবার মধ্যমণি ছিলেন লস্কর সিরাজউদ্দিন।
এর পরও একটা হতাশা থেকে যায়। একটা না পাওয়া থেকে যায়। একজন নায়ক লস্কর সিরাজউদ্দিনকে তো পাওয়া গেল। আরেকজন নায়ক কোথায়? সেই সুবেদার মোবাশ্বের আলী কোথায় আছেন, আদৌ আছেন কি না; এখনো জানতে পারেননি রাজশাহীবাসী। কোনো সূত্র বের হয়নি।
তবে অপেক্ষা চলছে। কে জানে, একদিন হয়তো রাজশাহীতে ফিরে আসবেন মোবাশ্বের আলীও। সেই অপেক্ষা করতে দোষ কী!
 সুত্র: প্রথম আলো। আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ | তারিখ: ১৯-০৩-২০১০

No comments: