৫০ বছর পেরিয়ে
অ্যাপোলো-১১তে চড়ে চাঁদে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রথম অন্য কোনো জগতে পা রেখেছিল। এর জন্য অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে এবং এই সাফল্যের কৃতিত্ব অনেকেরই। এ ঘটনার আগে অভিযান সফল করার জন্য চাঁদের কক্ষপথে অ্যাপোলো-৮ ও অ্যাপোলো-১০ নামের দুটি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালানো হয়।
আমি যখন কারও সঙ্গে অ্যাপোলোর অভিযান নিয়ে কথা বলি, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই প্রথম যে প্রশ্নটি করে তা হলো, চাঁদের অভিযানে কতজন মানুষ কাজ করেছে? আমি জবাবে বলি, ১২ জন। আর সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৪ জন পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদে গিয়েছেন। আমি ও অন্যান্য নভোচারী হাজার হাজার মানুষের কাছে ঋণী, যাঁরা বিভিন্নভাবে এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নানাভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন।
নাসা ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি মহাশূন্য নিয়ে গবেষণার কাজে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকায় ছিলাম এবং কিছু পথপ্রদর্শক প্রকৌশলী ছিলেন, যাঁরা অ্যাপোলোর প্রোগ্রাম তৈরির পাশাপাশি আমাকে নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। মহাকাশ নিয়ে গবেষণায় আমি ৪০ বছরের বেশি সময় যুক্ত ছিলাম।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ পাঠিয়েছিল। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক ধরনের শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।
আমি নতুন কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বৈমানিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি, পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবহর কীভাবে দ্রুত তার জবাব দেবে, সেই কৌশল রপ্ত করছি।
১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে ইউরি গ্যাগারিন যখন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে মহাশূন্যে উড়লেন, তখনই আমার সব চিন্তাচেতনার পরিবর্তন ঘটে গেল। এ সময় প্রেসিডেন্ট কেনেডিও ঘোষণা দিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই শতক শেষ হওয়ার আগেই একজন মানুষকে চাঁদে পাঠাবে। পূর্ব ও পশ্চিমের স্নায়ুযুদ্ধ এ সময় তুঙ্গে উঠেছে। বলতে দ্বিধা নেই, এই স্নায়ুযুদ্ধ মহাকাশ গবেষণায় দুই দেশের ক্ষেত্রেই দারুণ গতির সঞ্চার করে। আমরা অ্যাপোলো কার্যক্রমের গতি যতই বাড়াই না কেন, এটাও জানতাম, সোভিয়েতরাও মহাকাশে ওড়ার জন্য তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদেরও চৌকস কিছু প্রকৌশলী আছেন, বিশেষ করে প্রধান নকশাবিদ সারজি কোরোলেভ।
আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, চাঁদে অবতরণের জন্য এমন একটি যানের নকশা করতে হবে, যা পৃথিবীর কক্ষপথ, মহাকাশ বা চাঁদের চারপাশে, একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন হতে, আবার প্রয়োজনে জোড়াও লাগতে পারবে। মহাকাশযানটি তৈরির সময় এ কৌশলটি ব্যবহার করা হলো। এরই মধ্যে আমি মহাকাশ ভ্রমণের জন্য নানা কৌশল রপ্ত করছি। মাইকেল কলিন্স ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা পানির নিচেও পরীক্ষামূলক প্রশিক্ষণ নেব।
নাসায় যোগ দেওয়ার আগে আমি কিছুদিন স্কুবা ডাইভিং শিখেছিলাম। ফলে মহাকাশযানের পরিবেশ আর অপরিচিত মনে হয়নি। ফলে অ্যাপোলো শুধু আমার কাছে একটি দুর্বার ও অনন্য গতিশীল যান হিসেবেই মনে হয়নি, সঙ্গে এটাকে চ্যালেঞ্জও মনে হয়েছে, কত কম সময়ে আমরা নিজেদের সেখানে খাপ খাওয়াতে পারব এবং দেখাতে পারব রাশিয়াকে।
গত ৫০ বছরে মানুষের মহাকাশের বিভিন্ন কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখতে পাই, আমরা যা করেছি তার জন্য যথেষ্ট আনন্দ করার আছে। আমরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের করণীয় ঠিক করেছি। আগামী দশকের মধ্যেই আবার আমাদের চাঁদ থেকে ঘুরে আসা উচিত। এ ছাড়া আরেকটি ব্যাপার নিয়েও কাজ করার আছে, যেসব কৃত্রিম উপগ্রহ অকেজো হয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে ঝুলে আছে, সেসবও সরিয়ে ফেলতে হবে এবং তা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে।
—মোছাব্বের হোসেন সূত্র: স্পেসফ্লাইট বই থেকে
No comments:
Post a Comment