রঙে রাঙানো হোলি
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা, তথা দোলপূর্ণিমায় বাংলাদেশের হিন্দু-বৈষ্ণব মানুষেরা হোলি উৎসব উদ্যাপন করেন। কথিত আছে, একদিন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা তাঁদের সখাসখি বা ভক্তদের সঙ্গে এক জায়গায় বসে আলাপ করছিলেন। একসময় আকস্মিকভাবে শ্রীরাধার ঋতুস্রাব ঘটে। সখাসখি বা ভক্তদের কাছে শ্রীরাধা যেন বিব্রত না হন, সে জন্য হোলির আয়োজন করেন শ্রীকৃষ্ণ। অন্যদিকে একথাও বলা হয়, বর্ষ শুরুর আগে দেহ অশুচি থাকলে যমদূত কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই হোলি উৎসব করে রং মেখে দেহকে রাঙিয়ে তোলা হয়। প্রকৃতির বিচিত্র-বর্ণিল রঙের প্রতি একাত্ম হতেই হোলির প্রচলন হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। হোলি উৎসবে বিভিন্ন বর্ণের তরল রং একে অপরকে কখনো দূর থেকে ছিটিয়ে দেয়। কখনো আবার কাছে গিয়ে গায়ে-মুখে হাত দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে তরল রং মাখিয়ে দেয়। হোলি উৎসবে শুষ্ক রং মাখানো তেমন একটা চোখে পড়ে না।
শুধু রং ছিটানোই হোলি উৎসবের প্রধান আনন্দ নয়, হোলি উৎসবে বিভিন্ন স্থানে আদি রসাত্মক গানও পরিবেশন করা হয়। বাংলাদেশে হোলি উৎসবে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক ও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিরা, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। এসব অনুষ্ঠানে আজকাল হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান-খ্রিষ্টানদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। এ দেশের সবচেয়ে জমজমাট হোলি উৎসব হয় পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার কালীমন্দির এলাকায়।
পুণ্যস্নান
সাধারণত চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নান শাস্ত্রমতে নির্ধারিত। এ সময় নারায়ণগঞ্জ জেলার লাঙ্গলবন্দের আদি ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েক লাখ পুণ্যার্থী স্নান করেন। তাঁরা এই আদি ব্রহ্মপুত্র নদে নেমে ‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লোহিত্য, তুমি আমার পাপ হরণ করো’ এই মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সঙ্গে ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আমের পল্লব প্রভৃতি সহযোগে পুণ্যস্নান করে থাকেন। এই স্নান উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দের নদীতীরে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী বাসন্তী মেলা বসে। এই মেলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে বর্ণিল মেলা জমে ওঠে, তার পাশেই বসে সারা দেশ থেকে আগত সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানা। মেলার প্রকৃত অলংকার দেশি-বিদেশি বিচিত্র সব শখের সামগ্রীর পসরা, যেমন—কাঠের ঘর সাজানোর উপকরণ, মাটি-কাঠ-ঝিনুক দিয়ে তৈরি গয়না, শাখা, নকশি জুতা-স্যান্ডেল। এর বাইরে পুণ্যার্থীদের পূজার উপকরণ ও বাহারি খাবারের দোকান তো আছেই।
দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীরা পাপ মোচনের আশায় লাঙ্গলবন্দ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গান্ধীঘাট, রাজঘাট, ললিত সাধুর ঘাট, অন্নপূর্ণা মন্দির ঘাট, জয়কালী মন্দির ঘাট, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ী ঘাট, আকরী সাধুর ঘাটসহ মোট ১৪টি ঘাটে স্নান সম্পন্ন করে ফিরে যাওয়ার পথে পুণ্যস্নান মেলা থেকে স্মৃতিস্বরূপ কিছু না কিছু কিনে নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলার শহরের গাঙ্গিনার পাড়সংলগ্ন শম্ভুপুরের ব্রহ্মপুত্র নদেও হয় পুণ্যস্নান। সেখানেও নদীর পাড়ে মেলা বসে। ময়মনসিংহ ছাড়াও সুনামগঞ্জ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুরসহ আরও কয়েকটি জেলায়ও জাঁকজমকভাবে পুণ্যস্নান মেলা বসে।
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও কাওয়ালি
সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। একই দিনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এই দিনটিকে মুসলিম সম্প্রদায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে উদ্যাপন করে থাকে। এদিন বাংলাদেশের মুসলমানরা ইসলামের বিভিন্ন বাণীসংবলিত পতাকা বা নিশান-সহকারে শোভাযাত্রা, মিলাদ মাহফিল, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ইসলামি জলসা ও কাওয়ালি পরিবেশনের মাধ্যমে উদ্যাপন করে থাকেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি বিহারিরা ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে তাঁদের মহল্লাগুলোতে মঞ্চ সাজিয়ে হারমোনিয়াম, তবলা, চিমটি, বাঁশি বাজিয়ে বাংলা ও উর্দু ভাষার মিশেলে কাওয়ালি পরিবেশন করেন। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কাওয়ালির আসর। আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা গায়ক-শিল্পীদের সুরসংগীতে মুগ্ধ হয়ে টাকা ছুড়ে দিতে থাকেন। যে শিল্পী যত ভালো কাওয়ালি পরিবেশন করেন, তিনি তত বেশি টাকা উপহার পান।
লালনে দোল
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালনের সমাধি প্রাঙ্গণে দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক সাধু-ফকিরের সমাবেশ ঘটে। আগে দোলপূর্ণিমার এই সাধু সমাবেশ সাধুসঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। এই সাধুসঙ্গে লালনপন্থী সাধু-ফকির একত্র হয়ে গুরুকার্য পালন করতেন। লালন দোলপূর্ণিমার এই সাধুসঙ্গ প্রবর্তন করেছিলেন সাধু-ফকিরদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের পথ রচনা করার জন্য। তখনকার সাধুসঙ্গে সাধুগুরুরা একত্র হয়ে ভোরে গুরুকার্য সেরে দৈন্য গান গেয়ে নিয়ে দুপুর অবধি গোষ্ঠ গান পরিবেশন করতেন। এই গোষ্ঠ গানের অনুষ্ঠানের ফাঁকে মাঝখানে বাল্যসেবা ও দুপুরের স্নান সেরে নিতেন। দুপুরে গুরুকার্য, পারশ ইত্যাদির পর পূর্ণসেবা, সন্ধ্যায় গুরুকার্য ও প্রার্থনাগীতির পর মধ্যরাত্রি অবধি গান, জ্ঞানকথার আলাপন এবং শেষে অধিবাস অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমান লালন-প্রবর্তিত দোলপূর্ণিমার সাধুসঙ্গ সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়েছে। এখন দোলপূর্ণিমার আয়োজন পুরোপুরিভাবে ‘লালনমেলা’ বা ‘লালন স্মরণোৎসব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর চরিত্রগুণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বারোয়ারি মেলার সব লক্ষণ। যেমন এই মেলার একটি প্রান্তজুড়ে থাকে বাউলদের বাদ্যযন্ত্র বিক্রির দোকান। এসব দোকানে সাজানো বিচিত্র ধরনের একতারা, দোতরা, ডুগি, প্রেমজুড়ি বা কাঠজুড়ি, মন্দিরার ভেতর থেকে দেশ-বিদেশের সাধুরা তাদের প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্রটি কিনে থাকেন। অন্য প্রান্তে থাকে লালনপন্থী তাঁতি সাধুদের তাঁতে তৈরি গামছা-লুঙ্গি বিক্রির দোকান। এ ছাড়া থাকে প্লাস্টিকের সামগ্রী, কারুপণ্য থেকে শুরু করে আসবাবসামগ্রী, পাটি, মাটির পুতুল, মাটির হাঁড়ি, গয়না ইত্যাদির দোকান। পাশাপাশি সাঁইজির গানের ক্যাসেটসহ গানের বইও বিক্রি হয়। তবে ছেঁউড়িয়ার দোলপূর্ণিমার অনুষ্ঠান এমন মেলার চেহারা পেয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। আসলে বিগত শতকের পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত উৎসবটি ছিল শুধু সাধু-ভক্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে সময় এখানকার অনুষ্ঠানের একটি স্বতঃস্ফূর্ততাও বর্তমান ছিল। কিন্তু ষাটের দশকে লালন আখড়ার অনুষ্ঠান দুটি প্রশাসনিক সহায়তায় ক্রমশ আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে আবদ্ধ হয়ে এর স্বতঃস্ফূর্ত রূপটি হারিয়ে ফেলে।
তার পরও এ বছর দোলপূর্ণিমার অনুষ্ঠানের মধ্যে লালনের সমাধিকে ঘিরে একটি ভেক খিলাফত অনুষ্ঠান হয়েছে।
হেচড়া পূূজার গান
ফাল্গুন মাসজুড়ে গোপালগঞ্জ জেলার মতুয়া সম্প্রদায়ের কিশোরীরা হেচড়াপূজার আয়োজন করে। হেচড়াপূজার আয়োজন হিসেবে গ্রামের মেয়েরা বাড়ির ভেতর বা বাইরের উঠানে ফাল্গুন মাসের শুরুতে কুল বা বরইগাছের একটি শাখা পুঁতে দেয়। সেই শাখায় সাত রকম দেশি ফুল সাজিয়ে হেচড়াপূজার আস্তানা তৈরি করা হয়। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় সেই আস্তানার সামনে বসে গ্রামের মেয়েরা সমবেত কণ্ঠে হেচড়াপূজার গান গেয়ে থাকে।
সাধারণত গ্রামের মেয়েরা বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার জন্যই এই পূজা ও গান করে থাকে। এটা মূলত গ্রামজীবনের ঘরোয়া উৎসব। গানের কথা সাধারণত এ রকম—
‘মনের মতো করব পূজা মা তোমার ওই চরণে
ফুলও দিব জোড়ায় জোড়ায় মা বসন যত লাগে
মনের মতো করব পূজা মা তোমার ওই চরণে
মালা দিব জোড়ায় জোড়ায় মা বসন যত লাগে
মনের মতো করব পূজা মা তোমার ওই চরণে
শাঁখা দিব জোড়ায় জোড়ায় মা বসন যত লাগে
মনের মতো করব পূজা মা তোমার ওই চরণে’
গোপালগঞ্জের মতুয়াদের এই হেচড়াপূজার কথা বলতে গেলে তাঁদের প্রধান মেলাটির কথাও বলতে হয়। মতুয়াদের প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রধান মেলার নাম বারুণী মেলা। মতুয়ারা বলেন মহাবারুণী। প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী অর্থাৎ চৈত্র মাসের পূর্ণিমার আগের দিন হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে সপ্তাহব্যাপী এই মেলা শুরু হয়।
সুত্র: প্রথম আলো। সাইমন জাকারিয়া | তারিখ: ০৯-০৪-২০১০
No comments:
Post a Comment