এক বছর হলো মোমেন ভাই মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা মনে করিয়ে দিতে ডেইজি ভাবি নিজেই ফোন করেছিলেন। আমি বা আমার স্ত্রী রানু কেউ-ই সেই বার্তা পাইনি। আমাদের জবাব না পেয়ে আরেকজনের মারফত ফের মৃত্যুবার্ষিকীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ভাবি।
কী আশ্চর্য, এরই মধ্যে এক বছর হয়ে গেল? আব্দুল মোমেন—মোমেন ভাই পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বন্ধুবৎসল, সজ্জন, পরোপকারী, নেহাতই ভালো মানুষ। কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। খুব ধীরে ধীরে ও নিম্নস্বরে কথা বলতেন। গান ও কবিতা ভালোবাসতেন, কারও কাছ থেকে উৎসাহ পেলে দু-একটা কবিতা আবৃত্তিও করে ফেলতেন। খুব ভাবতেন বাংলাদেশের কথা। আশাবাদী মানুষ ছিলেন, দেশের কোনো কিছু ভালো চোখে পড়লে নিজে ফোন করে সে কথা ভাগাভাগি করে নিতেন। যা ভালো লাগত না, তা নিজের মনে রেখে দিতেন, কখনো সামনাসামনি দেখা হলে তা নিয়ে মতবিনিময় করতেন, তাও আবেগের বদলে যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে। খুব পছন্দ করতেন নিজের বাসায় বন্ধুবান্ধব ডেকে খাওয়াতে। কত কী পদের যে রান্নাবান্না করতেন। কিন্তু মোমেন ভাই বাচ্চা ছেলের মতো যে পেছনে লেগে থাকতেন, ‘এটা করো সেটা করো’ বলে তাঁদের পাগল করে তুলতেন, তা নিয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই।
এমন একজন লোক—বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ তাঁকে কেন চলে যেতে হয়?
ক্যানসার হয়েছিল মোমেন ভাইয়ের। হাসপাতালে শেষবার তাঁকে যখন দেখতে যাই, তত দিনে কথা বলার শক্তি তাঁর শেষ। চৌদ্দ রকম নল, দুই পামে নানা রকম মনিটর। আমি তাঁর শুকনো হয়ে আসা একটি হাত ধরেছিলাম। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। মুখে বলেননি, কিন্তু চোখ দিয়ে বললেন, আসার জন্য ধন্যবাদ। পায়ের কাছে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন ডেইজি ভাবি। তাঁর চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমার ছিল না। কেবিনের বাইরে আসার পর বিদায় জানাতে বাইরে এসেছিলেন। অসংখ্য নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি তাঁর চোখে, কিন্তু শুকনো সেই চোখ। আমি কী একটা কথা যেন বলেছিলাম, অমনি ঝরঝর কেঁদে ফেললেন।
গত এক বছরে এমন এক দিনও কি গেছে, যখন সেই চোখ ভিজে আসেনি? এক বছর পর ডেইজি ভাবির ফোন পেয়ে আমার এই প্রশ্নটাই সবার আগে মনে জাগল। একটা মানুষ ছিল, চারপাশে তাঁর সব স্মৃতিচিহ্ন, প্রতিটি জামা, প্রতিটি টাই, পুরোনো জুতা, বসার ঘর ও বারান্দার প্রতিটি ফুলের টব। সবই আছে, এক বছর পরও, কিন্তু তিনি নেই। এখানে নেই, কিন্তু অন্য কোথাও কি তিনি আছেন?
জোয়ান ডিডিয়ন তাঁর স্বামী জন ডিডিয়নের আকস্মিক মৃত্যুর পর এই এক বছরের কথাই লিখেছেন তাঁর দি ইয়ার অব ম্যাজিক্যাল লিভিং গ্রন্থে (প্রকাশকাল ২০০৫)। সেটি ২০০৩ সালের কথা। এক দুরারোগ্য ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তাঁদের মেয়ে কুইনতানা। মাত্র পাঁচ মাস আগে তার বিয়ে হয়েছিল। সেদিনও হাসপাতালে তাকে দেখে ঘরে ফিরেছিলেন জোয়ান ও জন। চল্লিশ বছরের সংসার তাঁদের, সবকিছুই অভ্যাসমাফিক। পুরোনো নিয়মে খাওয়ার টেবিলে বসেছিলেন জন, আহারের আয়োজন করছিলেন জোয়ান। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে লুটিয়ে পড়েন জন। জোয়ান ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি কী হলো। এক হাত উঁচু করে ধরা ছিল, তিনি ভাবলেন ঠাট্টা করছেন। এই কাজটি জন খুব ভালোভাবে করতে পারতেন না, সেই রকমই ব্যর্থ ঠাট্টা হয়তো। কিন্তু না, জন সত্যি সত্যি চলে গেলেন। কোনো কথা না বলে, কোনো বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে। জনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম বছরের স্মৃতিকথা—না, স্মৃতিকথা নয়, ধ্যানমগ্ন আত্মকথন দি ইয়ার অব ম্যাজিক্যাল লিভিং। জোয়ানের জন্য এই বছরটি ম্যাজিক্যাল শুধু সম্ভাবনার অর্থে, বাস্তবে নয়। কারণ এই এক বছর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তিনি অপেক্ষায় থেকেছেন—এই বুঝি তাঁর স্বামী ফিরে আসে। স্বামীর মৃত্যু হয়েছে—এ কথা মানা, মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। হয়তো এখনই ফিরে আসবেন, যেকোনো সময়—এমন এক জাদুকরি মুহূর্তের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছেন তিনি। স্বামীর ব্যবহূত কোনো কিছুই তিনি ফেলেননি। এমনকি পুরোনো নিত্যব্যবহার্য জুতা জোড়াও। মৃত মানুষ ফেরে না, কিন্তু স্বপ্নে দেখা দেয়, বারবার, এমনকি প্রতিদিন। জোয়ান লিখেছেন, সান্তা মনিকা এয়ারপোর্টে বিমানে উঠছিলেন তাঁরা দুজন, কিন্তু তাঁকে ফেলে একা জনকে নিয়ে তাঁর চোখের সামনে উড়ে গেল বিমান। স্বপ্ন, কিন্তু সত্যের চেয়েও কঠিন সেই স্বপ্ন। জোয়ান ডিডিয়নের এই বইয়ের কথা নতুন করে মনে পড়ল ডেইজি ভাবির ফোন পেয়ে। জোয়ান যাকে ‘ম্যাজিক্যাল লিভিং’ বলেছেন, সেই দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ রজনীর একাকী বন্দীজীবন তাঁকেও তো কাটাতে হয়েছে। তিনি বলেননি, কিন্তু আমি জানি জোয়ানের মতো তিনিও অজ্ঞাতে, অলক্ষে অথবা অভ্যাসের বসে স্বামীর অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করেছেন। আলমারিতে পরিপাটি করে রাখা স্যুট, নিজের প্রিয় শেলফে গোছানো প্রিয় বই, একজোড়া চটি জুতা। যতবার সেদিকে চোখ পড়েছে, কেবল তাঁকেই তো দেখেছেন। চোখ বুঝলে আমিও তো দেখি আমার বসার ঘরে কোনার সোফায় তিনি বসে, পরনে সদ্য পাটভাঙা রেশমি পাঞ্জাবি।
মৃত্যুর কথা আমরা খুব একটা বলি না, সচেতনভাবে এ নিয়ে ভাবিও না। জন্মের পর প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগোই, অথচ যত দিন বেঁচে থাকি, দু-হাত দিয়ে কেবল জীবনকে রোগ-শোক-মৃত্যু থেকে আগলে রাখি। নিজের জীবনকে ভালোবাসি বলেই মৃত্যুকে দূরে রাখতে চাই, তা নয়। নিজের জীবনের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি তাদের, যারা আমাদের চারপাশে। সন্তান, স্ত্রী, সব নিকটজন। আরও ভালোবাসি নিজের বইয়ের টেবিল, রবীন্দ্রনাথের গান, রাত জেগে ক্রিকেট খেলা দেখা।
অনেকে, যেমন আমাদের রবীন্দ্রনাথ, জীবন ও মৃত্যুকে আলাদা করে দেখেননি। তাঁর কাছে জীবন একটি দীর্ঘ যাত্রা। এর একদিকে দেহজ জীবন, অন্যদিকে মৃত্যু, যা আসলে দেহহীন আরেক জীবন মাত্র। মৃত্যু হলো বলেই যে জীবনের সমাপ্তি হলো, তা নয়। বরং জীবন নামক লম্বা সফরের এক ধাপ অতিক্রম, শুরু হলো আরেক ধাপ। ডাকঘর-এর অমল যেমন। মৃত্যুর বার্তা নিয়ে রাজার চিঠি আসছে জেনেও কী নিশ্চিত আনন্দ তার। যেন বেড়া ডিঙিয়ে বাগানের অন্য পাড়ে যাচ্ছে সে। এত প্রশান্তচিত্তে মৃত্যুকে গ্রহণ কি সম্ভব? মৃত্যুর পরেও কি দেহজ জীবনের স্মৃতি অক্ষুণ্ন থাকে? সেই দূর পরপার থেকেও কি ফেলে যাওয়া প্রতিটি ঘাসপাতা, রৌদ্রোজ্জ্বল প্রতিটি দিনের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে ফেলে রেখে যাওয়া প্রিয়জনের কথা? এই স্মরণ যদি সত্যি হয়, তাহলে পরজনমে কোনো স্বর্গে গিয়েও কি কেউ শান্তি পায়? মহাকালের দোলন ঝুলনায় কত কাল-কত অনন্তকাল-বিগত জন্মের সব স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে?
যারা চলে গেল, তাদের কথা জানিনি। কিন্তু যারা রয়ে যায়, মৃত্যুর পরও সব স্মৃতিভার তাদের বহন করতে হয় আমৃত্যু। সময়ের ব্যবধানে সেই স্মৃতিতে ধুলো হয়তো জমে, কিন্তু সেই ধুলো সরালেই আগের সব জ্বলজ্বলে। সুধা বলেছিল, সে অমলকে ভুলবে না। আমরা কেউ-ই আমাদের অমলকে ভুলি না, এমনকি সময়ের দীর্ঘ পদবিক্ষেপের পর, যখন স্মৃতি ও বিস্মৃতির সব তারতম্য অপস্রিয়মাণ, তখনো। যেন ভোকাট্টা ঘুড়ি। নীল আকাশ থেকে সুতাকাটা সেই ঘুড়ি হারিয়ে গেলেও মনের আকাশ থেকে সে মিলিয়ে যায় না।
২২ মার্চ ২০১০
নিউইয়র্ক
সুত্র: প্রথম আলো। হাসান ফেরদৌস | তারিখ: ০৯-০৪-২০১০
No comments:
Post a Comment