১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম বাংলাদেশের; নতুন এক দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে এর আবির্ভাব। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সেই সময়ে নানাভাবে সমর্থন জুগিয়েছে বিশ্ববাসী। সে রকমই এক উদ্যোগের অংশ হিসেবে কলকাতায় আসেন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। বাঙালি শরণার্থী শিবিরের লাখো মানুষের দুর্দশা নিদারুণভাবে আলোড়িত করে গিনসবার্গকে। নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে (১৪-১৬ নভেম্বর) তিনি রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
দ্য ফল অব আমেরিকা বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। গিনসবার্গ এই কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে তাঁর কলকাতা সফরের মধ্য দিয়ে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিনসবার্গের হাতে; পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে এসে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে—গিনসবার্গের কাজ হবে সরেজমিন ঘুরে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা। কলকাতায় গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসির হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান শরণার্থী শিবিরগুলোয়। শত শত অসুস্থ, ক্ষুধার্ত মানুষ গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে শরণার্থী শিবিরে, কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠায় করে নিয়েছে ঝুপড়িগুলোয়। খাবার নেই, পানি নেই, স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই—মানুষের এই অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার দেখে গিনসবার্গ ভীষণ মর্মাহত হলেন। শরণার্থী শিবিরের অভিজ্ঞতা তাঁকে নিদারুণভাবে আলোড়িত করল। দুঃস্বপ্নের মতো তাঁর এই স্মৃতি বিশ্ববাসী ও মার্কিনদের গোচরে আনার জন্য তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়েই লিখলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ঘটে চলা ওই বর্বরোচিত ঘটনার পেছনে যারা ইন্ধন দিয়ে, পাকিস্তানকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে, যারা একই সঙ্গে নির্যাতন চালাচ্ছে ভিয়েতনামে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশও খুলে দেওয়া। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডে’ গিনসবার্গ এঁকেছেন শরণার্থী শিবিরে বাঙালি শরণার্থীদের চেহারায় যে চরম দুঃখ-কষ্ট, হতাশা ও মৃত্যু দেখেছেন সেই হদয়বিদারক চিত্র। শরণার্থী শিশুকে বলেছেন ‘স্ফীত উদর’ ব্যথায় ‘কান্নারত’, মা-বাবার চোখে-মুখে দেখেছেন ‘অনাহারে মৃত্যুর শঙ্কা’, আর মুমূর্ষু বৃদ্ধের চোখে-মুখে ‘উন্মাদপ্রায়’ দৃষ্টি। গিনসবার্গ আকুল আবেদন জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে; বলেছেন, এগুলো শুধু টিভিদৃশ্য নয়, এগুলো সত্যি, বাস্তব। গিনসবার্গ আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব সমস্যা নিয়ে মনোযোগী নয়, তারা অবাস্তব সমস্যার পেছনে ছুটছে। দুনিয়ার আরেক প্রান্তে অপ্রয়োজনে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অথচ মার্কিন সরকার মানবতার দম্ভ করছে, তুচ্ছ কারণে ধ্বংস করছে হাজার মানুষের প্রাণ, তাদের আর্তনাদ প্রশাসনের কানে পৌঁছাচ্ছে না। তাই কলকাতাবাসী যখন আর্তনাদ করে বলে, কোথায় আমেরিকার বিমানবাহিনীর আলোর বহর? জবাবে গিনসবার্গ হতাশ, দুঃখিতভাবে বলেন, ‘তারা রাতদিন বোমাবর্ষণে ব্যস্ত উত্তর লাউসে।’
অনেক সমালোচকের মতে, গিনসবার্গের আরেক বিখ্যাত কবিতা হাউল আর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর বিষয়বস্তু প্রায় এক। পার্থক্য, ‘যশোর রোড’ গিনসবার্গ লিখেছেন গানের লিরিকের কথা মাথায় রেখে। গায়ক-কবি ডিলান টমাসের কথা মাথায় রেখে। সেই সময় গিনসবার্গ দারুণভাবে মজে ছিলেন বব ডিলানের গানে। তাই এই কবিতায় ছিল ডিলানের শক্তিশালী প্রভাবও।
যে কারণে, পরে ডিলানের সহযোগিতায় গিনসবার্গ নিজেই গেয়েছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। অ্যালবামও বেরিয়েছিল। এ কথা ঠিক, কিথ রিচার্ড অর্থ জুুগিয়েছিলেন গিনসবার্গকে কলকাতা সফরের, কিন্তু গিনসবার্গ মানসিক ও শৈল্পিক সমর্থন পেয়েছিলেন বব ডিলান ও বিটলসখ্যাত জন লেননের কাছ থেকে।
১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে ফিরে গিনসবার্গ তাঁর একদা কবিতার গুরু এজরা পাউন্ড নয়, তিনি সাক্ষাতে প্রত্যাশী ছিলেন জন লেননের। নিউইয়র্কে পৌঁছেই তিনি ছুটে যান জন লেনন ও ইয়োকো ওনোর (লেননের স্ত্রী) অ্যাপার্টমেন্ট সাইরাকুসে। জন লেননকে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ পড়ে শোনান তীব্র উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে, কিন্তু কবিতা পাঠ শেষে গিনসবার্গ যখন লেননের চোখে পানি দেখেন, বোঝেন তিনি সফল হয়েছেন। লেননও তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাকে গানে রূপ দেওয়ার।
ওই বছরই, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক কবিতার আসরে আবৃত্তি করেন গিনসবার্গ, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। সেই সময় অগণিত দর্শকের ভিড়ে উপস্থিত ছিলেন বব ডিলানও। তিনি গিনসবার্গের কবিতাপাঠে মুগ্ধ হয়ে সে রাতেই হাজির হন গিনসবার্গের অ্যাপার্টমেন্টে। তখনই শুরু হয় বব ডিলানের উদ্যোগে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর গান হয়ে ওঠার প্রয়াস। কণ্ঠ ছিল গিনসবার্গের, পেছনে গিটারে ছিলেন বব ডিলান স্বয়ং। প্রাথমিকভাবে এই গানে গিনসবার্গ হারমোনিয়াম ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ডিলানের গিটারের সঙ্গে কিছুতেই মিলছিল না। উজ্জীবিত গিনসবার্গ পরবর্তী সময়ে অনেকবার এই গান গেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে অবশেষে জন লেননের পরামর্শ মেনে গানটি রেকর্ড আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৬ সালে যুগোস্লাভিয়া থেকে ‘গোল্ডেন র্যাথ আজীবন সম্মাননা’ গ্রহণ করেন। গিনসবার্গ মনে করতেন, কবিতা থেকে গানে রূপ দিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’কে তিনি আরও উঁচু মর্যাদায় আসীন করেছেন।
অ্যালেন গিনসবার্গ (৩ জুন ১৯২৬—৫ এপ্রিল ১৯৯৭) আমেরিকান এই কবি সামরিকতন্ত্র, বস্তুবাদ ও নানা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ১৯৫০ সালে বিট প্রজন্ম, যাঁরা ছিলেন একদল উচ্ছল, প্রথাবিরোধী রাগি তরুণ কবির দল।
No comments:
Post a Comment