সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়ার গোছগাছ শেষ আজগর শেখের। তাঁরই মতো তৈরি বুড়িগোয়ালিনীর অন্য জেলেরাও। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এই গ্রামের জেলেদের মন এখন সমুদ্রের হাতছানিতে অস্থির। এই সময় তালপট্টির স্মৃতি বলতে গিয়ে বেদনার্ত হয়ে ওঠে আজগর শেখের মন।
দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের ৩০ বছরের কাজিয়ার ইতিহাস তাঁর জানা নেই। দরকারও নেই। তাঁর দুঃখ একটাই, দক্ষিণ তালপট্টি আর নেই। সমুদ্র থেকে উঠেছিল, সমুদ্রেই গেছে তলিয়ে। কেওড়াগাছের সারি, নানা পাখপাখলির অবাধ ওড়াউড়ির কথা মনে পড়ে তাঁর। ওইখানে গেলে সুন্দরবনের স্বাদ পেতেন তিনি। হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর পূর্ব দিকে তাকালে এখন শুধু সাগর আর সাগর। বুড়িগোয়ালিনী বাজারের শিক্ষিত লোকেরা তাঁকে বলেছেন, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে তালপট্টি। আইলা আঘাত হানার পর হাড়িভাঙ্গা নদীর মোহনায় গিয়ে দক্ষিণ তালপট্টিকে আর খুঁজে পাননি তিনি। সমুদ্রের বুকে মিশে গেছে ওই একখণ্ড সুন্দরবন। কয়েক বছর ধরেই তাঁর মনে হচ্ছিল ভাটার সময়ও চরটি আগের মতো পুরোপুরি জেগে উঠছে না। তাই হারিয়ে যাওয়ায় অবাক হননি তিনি।
২০১০ সালের ২০ মার্চ ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক সুগাতো হাজরা বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তালপট্টি বিলীন হওয়ার কথা জানান। স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে নেওয়া ছবি দেখে ও সমীক্ষা চালিয়ে তিনি গণমাধ্যমের কাছে জানান, দ্বীপটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। ৩০ বছর ধরে এ ভূখণ্ডটির মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। সুগাতো হাজরার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিই দুই দেশের এই দ্বন্দ্বের সমাধান করে দিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা তিন মিলিমিটার হারে বাড়ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর এই হার পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ১৯৯৬ সালে পার্শ্ববর্তী লোহাছাড়া দ্বীপটিও তলিয়ে যায়। আরেক দ্বীপ ঘোড়ামারার অর্ধেক এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে। এই এলাকার আরও ১০টি দ্বীপ তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে আছে।
সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও তিন কিলোমিটার প্রস্থের এ দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও অনেক ডামাডোল হয়েছে। আন্দোলন-রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে শুরু করে রাজনীতির চায়ের আড্ডা কিংবা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও নেওয়া হয়েছিল নানা উদ্যোগ। ভারতের পক্ষ থেকে একে দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করে নাম দেওয়া হয়েছিল পূর্বাশা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হলো, এটি একটি বালুর চর, নাম দক্ষিণ তালপট্টি। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সীমানা তালপট্টি দ্বীপের দক্ষিণ অংশ হিসেবে এটি জেগে উঠেছে।
একাত্তরে উদয়, ২০১০-এ অস্ত: একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে তার উদয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার দাবি করল, চব্বিশ পরগনা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় একটি নতুন দ্বীপের উদয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইআরটিএস ল্যান্ড রিসোর্স স্যাটেলাইট ১৯৭৪ সালে বলল, ‘হ্যাঁ’, হাড়িয়াভাঙ্গা এস্টুয়ারি (সমুদ্র থেকে ভূখণ্ডে প্রবেশ করা জলরাশি) মোহনায় আড়াই হাজার বর্গমিটার আয়তনের একটি ভূমি জেগে উঠেছে। ভাটার সময় ভূখণ্ডটি ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
সমুদ্রবিজ্ঞানবিশারদেরা ভূখণ্ডটির উত্পত্তির কারণ ও ধরন নিয়ে মতামত দেওয়া শুরু করলেন। কেউ বললেন, একাত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আসা বিস্তর পলি ওই এলাকায় জমা হয়ে ভূখণ্ডটি সৃষ্টি হয়েছে। সব পলি জমাট বেঁধে স্থায়ী ভূখণ্ড বা দ্বীপ হিসেবে তৈরি হতে আরও সময় লাগবে। বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন মেঘনা এস্টুয়ারি অংশে বাংলাদেশের নোয়াখালী উপকূলে এ ধরনের অসংখ্য অস্থায়ী চর জেগে ওঠে ও ডুবে যায়। জোয়ার-ভাটার টানে এই চরগুলোর পলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা যে যা-ই বলুন না কেন, আশির দশকের পুরো সময় তালপট্টি নিয়ে দুই দেশের রাজনীতির মাঠ জমে ওঠে। একাত্তরের মিত্ররাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের শীতলতা শুরু হয় তালপট্টিকে কেন্দ্র করে। ১৯৭৯ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী দেশাই বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশ সরকার তালপট্টির ব্যাপারে একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দেয়। এরপর রাজনীতির পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। তালপট্টি নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুরাহা না হলেও দুই দেশের জেলেরা মাছ ধরার ফাঁকে মিলেমিশে এই চরে আশ্রয় নিয়েছেন।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পক্ষ থেকে তালপট্টি দ্বীপের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য একটি স্যাটেলাইট ইমেজভিত্তিক সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে চরটির বাংলাদেশ অংশের পশ্চিম দিক জেগে উঠছে। ১৯৯০ সালে আরেকটি স্যাটেলাইট ইমেজে চরটিকে ক্ষয়ে যেতে দেখা যায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে দ্বীপটিকে আর দেখা যাচ্ছিল না বলে জানান সিইজিআইএসের বিজ্ঞানীরা।
তালপট্টি দ্বীপের ৪৩ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের অতল এলাকা (সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড)। এ কথা সুন্দরবনের জেলেরাও জানেন। বুড়িগোয়ালিনীর অপর জেলে আবদুস সালামের মতে, দক্ষিণ তালপট্টি মনের দুঃখে সমুদ্রে ভেসে গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামের মতে, সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আসা পলি ঘটনাক্রমে এক জায়গায় জড়ো হয়ে দক্ষিণ তালপট্টির সৃষ্টি করেছিল। ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসে তা ধুয়ে গেছে।
হয়তো আবদুুস সালাম বা আজগর শেখের কথাই ঠিক। রাজনৈতিক মীমাংসা না হওয়ায় আত্মপরিচয়হীন এই ভূখণ্ডটি সমুদ্রের অতলে আত্মাহুতি দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে এই দ্বীপগুলোর সাগরগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার কারণ বলা সম্ভব না। জলবায়ুর পরিবর্তন নয়, অন্য কারণেও সাগরে দ্বীপ জেগে উঠতে পারে, আবার তা হারিয়েও যেতে পারে। দক্ষিণ তালপট্টি এক্ষেত্রে বড় প্রমাণ।
ইফতেখার মাহমুদ | তারিখ: ০৬-০৮-২০১০ সুত্র: প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment