Sunday, October 3, 2010

মানবতার করুণ পরাজয়

৬ আগস্ট ১৯৪৫। এই দিনে হিরোশিমায় প্রথম আণবিক বোমা ফেলা হয়। হিরোশিমা ঘটনার ১০ বছর পর ১৯৫৫ সালে স্বচক্ষে দেখা ঘটনাবলী নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘হিরোশিমা ডায়েরি’। সেই ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে আসা চিকিত্সক মিচিহিকো হাচিয়া-র স্মৃতিচারণার কিছু অংশ এখানে অনূদিত হলো

সেই সকালে আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। আগের রাতে হিরোশিমা কমিউনিকেশনস হাসপাতালে রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।
তার পরও সকালটার কথা স্পষ্টই মনে আছে আমার। ঝকঝকে রোদ চারদিকে। ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম, বাড়ির সামনের বাগানটায় প্রচুর ফুল। ফুলের উজ্জ্বল রঙে যেন গোটা বাড়িটাই হাসছে। মনটাই ভালো হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে বৈঠকখানায় বসলাম। হঠাত্ এক আলোর ঝলকানি আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। মনে হলো, যেন শত-সহস্র ওয়াটের আলো কেউ আমার চোখে ফেলে নিভিয়ে দিল। একটু ধন্ধে পড়ে গেলাম। কী হলো! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, যেখানে একটু আগে রোদ ঝকঝক করছিল, সেখানে আর রোদ নেই। রোদ সরে গিয়ে যেন চারদিকে কালো মেঘে অন্ধকার। এত ধূলিধূসর কেন চারদিক? তখনো আমি জানি না কী ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে আমার এই শহরটায়।
চারদিকে বিকট আওয়াজ। সবকিছু যেন ভেঙে পড়ছে? ভূমিকম্প নয়তো! বাড়ির সবকিছু ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। লক্ষ করলাম, আমার শরীরের ডান দিকটা অবশ হয়ে আসছে। দুই হাত রক্তাক্ত। ঘাড়ে যেন ধারালো কিছু বিঁধে গেছে। হঠাত্ মনে পড়ল আমার স্ত্রীর কথা। ও তো রান্নাঘরে ছিল। আমার জন্য সকালের খাবার তৈরি করছিল। আমি চিত্কার করে উঠলাম...‘ইয়াকো সান! ইয়াকো সান!! কোথায় তুমি?’ ইয়াকো সান আমার স্ত্রীর নাম।
আমার স্ত্রী ভয়ার্ত গলায় চিত্কার করে বলল, ‘কী হচ্ছে, এসব কী হচ্ছে?’
আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার নয়, হিরোশিমাবাসী বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগের শিকার হয়েছে। স্ত্রীকে কাছে পেয়ে সংবিত্ ফিরে পেলাম, যদি বাঁচতে চাই আমাদের দুজনকেই বাড়ির বাইরে যেতে হবে। ততক্ষণে অসম্ভব তৃষ্ণায় আমায় বুকের ছাতি যেন ফেটে আসছে। স্ত্রীকে বললাম, ‘পানি খাব।’ সে চিত্কার করে বলল, ‘কোথায় পানি পাব?’ নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি, একি! আমি পুরোপুরি নগ্ন। কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নয় এখন। চারপাশের ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যুভয় আমার মন থেকে সব স্বাভাবিক মানবিকতাবোধ হাওয়া করে দিয়েছে।
কোনোমতে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এলাম। পথে এক সৈনিকের কাছ থেকে একখণ্ড কাপড় চেয়ে নিয়ে কোনোমতে লজ্জা ঢাকলাম।
আমি হাঁটতে পারছি না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর সারা শরীর রক্তাক্ত। পোশাক ছিঁড়ে গেছে। সেও আহত। আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো শারীরিক শক্তি তাঁরও নেই। কিন্তু আমাদের এগোতে হবে। যেতে হবে হিরোশিমা কমিউনিকেশনস হাসপাতালে। আমার কর্মস্থলে। সেখানে গেলে প্রাথমিক চিকিত্সা নিশ্চয়ই পাব। পিপাসা মেটাতে একটু পানিও নিশ্চয়ই পাব।
রাস্তায়, আমার চারপাশে সে এক নারকীয় অবস্থা। প্রাণভয়ে লোকজনের চিত্কার, ছোটাছুটি। সবাই রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। একজনকে দেখলাম, কনুই থেকে দুটো হাতই আলাদা হয়ে গেছে। চামড়ার সঙ্গে সেগুলো কেবল ঝুলছে। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশ যে কয়টা দেখলাম, তার কোনো হিসাব নেই। এর মধ্যে হঠাত্ খেয়াল হলো, আমার স্ত্রী সঙ্গে নেই। কোথাও দেখছি না, যদ্দুর মনে পড়ে, ভিড়ের মধ্যে আমার চেয়ে খানিকটা এগিয়ে ছিল ও।
‘ইয়াকো সান, তুমি কোথায়?’ হঠাত্ নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগল। শক্তিহীন এক জড় পদার্থ মনে হলো নিজেকে। কোনোমতে আহত পা দুটো টেনে নিয়ে গেলাম একটা খোলা প্রান্তরের উদ্দেশ্যে। এ শহরে আমার জন্ম। আমার বেড়ে ওঠা। অথচ কিছুই যেন চিনতে পারছি না। সব জায়গায় কেবলই ধ্বংস। স্ত্রীর জন্য প্রবল উত্কণ্ঠা হলো।
খোলা জায়গাটায় গিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মাটিতে শুয়ে পড়লাম। দেখি আরও অনেকেই আছে। কিন্তু তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কারও হাত নেই, পা নেই। কারও সারা শরীর রক্তাক্ত। হঠাত্ একটি মেয়েকে দেখলাম, শরীরে কাপড় নেই। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পড়ে আছে। বেঁচে আছে বলে মনে হল না। চোখ সরিয়ে নিলাম। আমার পাশেই পড়ে রয়েছে আরেকজন নগ্ন পুরুষ। মনে হচ্ছিল, কোনো বিচিত্র কারণে আমাদের কারও শরীরে কাপড় নেই।
(১৯৮০ সালে মিচিহিকো হাচিয়া মৃত্যুবরণ করেন)
ভাষান্তর: নাইর ইকবাল

সুত্র: প্রথম আলো তারিখ: ০৬-০৮-২০১০

No comments: