Sunday, October 3, 2010

বিয়োগান্ত নাটকের মাইকেল

মাইকেল জ্যাকসন জীবনের সেরা চমকটি যেন তুলে রেখেছিলেন সব শেষে দেওয়ার জন্য। শ্রোতাদের ওপর ছিল তাঁর এক সম্মোহনী নিয়ন্ত্রণ; সুরের ও শরীরের অপূর্ব ভঙ্গিমায় দর্শকদের মুগ্ধ করে এনে ছুড়ে দিতেন নিঃসীম এক নীরবতায়। মাইকেল এক অসামান্য প্রতিভাধর সন্দেহ নেই, কিন্তু অপরিমিত, ভাবপ্রবণ, অপরিক্ব, বোধকরি অপরাধীও। কিন্তু তাঁকে অবজ্ঞা করে কার সাধ্য। এ রকম মৃত্যু তো তাঁরই হওয়ার কথা। সেজন্যই বোধকরি এমন রাজসিক বিদায়। আর তাই, তাঁর মৃত্যুতে ইন্টারনেট, মানব জাতির সবচেয়ে বড় মঞ্চ অচল হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। মধ্যবয়সী এই লোকের অকস্মাৎ মৃত্যুতে (২৫ জুন ২০০৯) ওয়েব আক্ষরিক অর্থেই থমকে যায়; ‘মাইকেল জ্যাকসন’ নাম দিয়ে অযুত, নিযুত অনুসন্ধানে বিকল হয়ে পড়ে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন। যে দিন মাইকেল মারা যান, প্রতি মিনিটে টুইটারে টুইটের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফলে বিধ্বস্ত টুইটারে অনেকেই নিজের অ্যাকউন্টে ঢুকতে পারেননি। উইকিপিডিয়ায় মাইকেল জ্যাকসন পেইজে ভক্তদের শত শত নতুন তথ্য সংযোজনের ফলে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়ে এই সাইটটিও। ইন্টারনেটে একই সময়ে শুরু হয়ে যায় মাইকেল জ্যাকসনের নানান জিনিসের বেচাকেনা। জ্যাকসনকে নিয়ে প্রায় ২৪ হাজারের মতো সংগ্রহ নিলামে তোলা হয় অতিশয় দ্রুততায়।
মাইকেল জ্যাকসনের মাথায় সেরার মুকুটটি জুটে গিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে আরেকবার যেন প্রমাণিত হলো পপসম্রাটের সেরার মুকুটটি এখনো তাঁরই দখলে। আর তাই ২০০৯ সালের জুন মাসের ২৫ তারিখে অল্প সময়ের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিল গোটা পৃথিবী।
এটা শুধু অন লাইনের বেলায় নয়, হাজার হাজার লোক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে জড়ো হয়েছিল হলিউডে, হারলেমে গ্রে’র জ্যাকসনদের বাড়ির সামনে, নিউইয়র্কে। বিভিন্ন এয়ারপোর্টের যাত্রীরা থমকে দাঁড়িয়েছিলেন টিভি স্ক্রিনের সামনে। রাস্তায় রাস্তায়, করাচি-প্যারিস থেকে মেক্সিকো-মস্কো পর্যন্ত মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বেইজিংবাসী মোমবাতি জ্বালিয়ে নিশিপালন করেছে মাইকেলের জন্য।
মাইকেল হয়তো জানতেন তাঁর শেষ বিদায় হবে এমনই জাঁকজমকপূর্ণ। পপ কালচারের বিশ্বায়নের সুবাদে এ ধরনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে আগেও বিশ্বব্যাপী শোক প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। এলভিস, ডায়ানা, জ্যাকসন একই প্যাটার্ন—সবগুলো মৃত্যু যেন একই সুতোয় গাঁথা। যেদিন মাইকেল মারা যান, সেদিন তাঁর সাবেক স্ত্রীদের একজন, মেরি প্রেসলি তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন: জ্যাকসন একবার তন্ময় হয়ে তাকে দেখতে দেখতে বলেছিল, ‘আমার পরিণতিও হয়তো ওর (এলভিস) মতো হবে, আমিও ওভাবে শেষ হব।’ এলভিস অত্যধিক ড্রাগ গ্রহণকারীদের একজন। ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে টয়লেট থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে বেরোনোর সময় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এলভিসের মৃত্যু হয়েছে হূৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহসংক্রান্ত জটিলতায়। মাইকেলকেও তড়িঘড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয় হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে।
প্রতিটি সেলিব্রেটির শেষ বিদায়ে নাটক মঞ্চস্থ হয় তিন অঙ্কে। এর প্রথমটি হলো বিভ্রান্তি। এলভিসকে কারও নজরে পড়তে এত সময় লাগল কেন? কেন এত দীর্ঘসময় টয়লেটের মেঝেতে পড়ে থাকলেন তিনি? দ্রুতগতির গাড়িতে ডায়ানা কেন সিটবেল্ট ব্যবহার করেননি? জ্যাকসনের স্বাস্থ্য নিয়ে আগে থেকে নানা সমস্যার কথা চাউর ছিল। তিনি যদি অসুস্থই হবেন, তাহলে তাঁর ওই নাজুক অবস্থা নিয়ে কেউ কিছু করল না কেন? চিকিৎসক কনরাড মারের তো জানার কথা, তিনি কী ওষুধ দিচ্ছেন—এসব প্রশ্নের জবাব আগেও মেলেনি, মাইকেলের ক্ষেত্রেও মিলবে না, মেলেনি এখন পর্যন্ত।
ফিসফাস ছিল, লন্ডন কনসার্টের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে জ্যাকসন পেইনকিলার নিচ্ছেন। কেউ মাথা ঘামায়নি তার পরও। অনেক বছর ধরেই মাইকেল নানা ধরনের ড্রাগ নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর পর মাইকেল পরিবারের এক সদস্য টিএমজেড ডটকমে বলেন, মাইকেল প্রতিদিন ডেমরল পেইনকিলার নিতেন। অতি মাত্রায় ডেমরল গ্রহণে শ্বাসকষ্টের সঙ্গে হূৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। এর পরিণতিতে হঠাৎ মৃত্যু ঘটতে পারে যে কারও। এটা একজন চিকিৎসকের বক্তব্য।
সেলিব্রেটি বিয়োগান্ত নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কটি প্রথমটির মতো ধোঁয়াশাপূর্ণ বা বিভ্রান্তিমূলক নয়। এই অঙ্কের দৃশ্যাবলি খুবই পরিষ্কার, কৌতূহলোদ্দীপক। উদাহরণ: ডায়ানার মৃত্যুর পর আচমকা নানামুখী প্রশংসায় ভাসতে লাগলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা গেলেন। লন্ডনের রাস্তায় শোক প্রকাশ করতে গিয়ে এক অপরিচিত আরেক অপরিচিত লোককেও জড়িয়ে ধরতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না (যা লন্ডনবাসীর চরিত্রের সঙ্গে কিছুতেই যায় না), বিশ্বজুড়ে সেলিব্রেটিদের যাঁরা ডায়ানাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তাঁদের হূদয়ভাঙা শোকবার্তাও ছিল অফুরান।
এমনটি ঘটে জ্যাকসনের বেলায়ও। ব্রুক শিল্ডের বাণী: মাইকেল ছিল তার এক অসাধারণ বন্ধু। বিশ্বের এক অসামান্য শিল্পীও। এলিজাবেথ টেলর বলেন, মাইকেল আর তার বন্ধুত্ব ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে খাঁটি বন্ধুত্ব। কিন্তু বেঁচে থাকতে কেউ কিছু করেনি।
মাইকেল অন্যের জন্য জীবনপাত করে গেছেন। সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। খুশি করার চেষ্টা করেছেন মা-বাবাকে, বন্ধুবান্ধবসহ বিধ্বংসী, আগ্রাসী মিউজিক প্রডিউসার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও।
তৃতীয় ও শেষ অঙ্কটি একটু দীর্ঘ: এখনো মৃত্যুরহস্যের কোনো সুরাহা হয়নি। ঋণভারে জর্জরিত মাইকেলের এস্টেটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আপাতত জ্যাকসনের সন্তানদের প্রতিপালনের অধিকার কে পাবে, তার সুরাহা হয়েছে। ভবিষ্যতে অমীমাংসিত আরও অনেক বিষয় সময় সময় নতুন চমক হয়ে মাইকেল ভক্তদের সামনে আবির্ভূত হবে, সংবাদপত্রের হেডিং হবে। সম্প্রতি মাইকেলের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত যে চিকিৎসককে গভীরভাবে সন্দেহ করা হচ্ছিল, তিনিও পুনর্বার প্র্যাকটিস শুরুর অনুমতি পেয়ে গেছেন। এ রকম অনেক খবর দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রকাশ হবে। এলভিস, ডায়ানা এ রকম অনেক অমীমাংসিত মৃত্যুর মতো মাইকেলের মৃত্যুও হয়তো বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্নই হয়ে থাকবে।
যেদিন তিনি মারা যান, অনেকে যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা তাঁকে বর্ণনা করেছেন একজন ‘ভদ্র’ মানুষ হিসেবে। এটা অনেকটাই নিয়মরক্ষার প্রয়াস কিংবা এক ধরনের কৈফিয়ত কিংবা ক্ষমা। আসলে মাইকেল ছিলেন সেই রকম একজন, যার নিজের ওপর পুরো কর্তৃত্ব ছিল না, সময়ের আগেই যে বালক পরিণত হয়েছিল পুরুষে, পরে পরিণত পুরুষ থেকে যে ফিরে যেতে চেয়েছিল সেই বালকত্বে। তাঁর সেরা কৃতিত্ব রচিত হয়েছে ২৫ জুনে। তাঁর ওই অকস্মাৎ মৃত্যুতে নিশ্চিতভাবে উচ্চকিত করেছে এই প্রশ্নকে; আরও অনেক দিন বিস্ময় নিয়ে আমরা ভাবব, আসলে কী ছিলেন তিনি, কে ছিলেন তিনি! কাজেই শেষ অঙ্কের যবনিকা এখনই নয়।
সুত্র: প্রথম আলো
আলীম আজিজ | তারিখ: ২৫-০৬-২০১০

No comments: