Sunday, October 3, 2010

 সব পাখি ফেরে এই দেশে

ধরে নেওয়া হয়, বিশ্বে পাখির প্রজাতির সংখ্যা নয় হাজার ৮০০, যার মধ্যে এক হাজার ৮৫৫টি বা ১৯ শতাংশ পরিযায়ী প্রজাতি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই দেখা যায় প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি, যার মধ্যে প্রায় ৩২৫ প্রজাতি কোনো না কোনোভাবে পরিযায়ী। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ পাখি পরিযায়ী, বাকিরা স্থানীয়। পরিযায়ীরা শীত মৌসুমের আগে-পরে এ দেশে আসে।
আকাশের হাতছানি ঠেকানোর যেমন কোনো উপায় বেশির ভাগ পাখির নেই, তেমনি তাদের নেই বাংলার মাটি, জলরাশি, শ্যামলিমা, পাহাড়-পর্বত, আর্দ্র-বাতাস, বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল, দিগন্তব্যাপী ফসলের খেত আর সবুজে ঘেরা হাজারো গ্রামের আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায়।
তাই তারা ফিবছর ও ঋতুভেদে হাজারে-বিজারে আসে আমাদের হাওর-বিল-বাঁওড়ে, নদীচরে ও মোহনা অঞ্চলে। শীত ও এর আগে-পরের ঋতুতে যে শত সহস্র হাঁস, রাজহাঁস, চখাচখি, জলকবুতর বা গঙ্গাকৈতর, গাংচিল এবং জলাভূমির পাখিরা আসে; আমরা এসব পরিযায়ী পাখিকে ভুল করে মেহমান, অতিথি, ভিনদেশি বা শীতের পাখি বলে চিহ্নিত করে থাকি।
ধরুন প্রতিবছর আমাদের দেশে আসে এমন পাখির সংখ্যা ১০ লাখ। কিন্তু আমরা সচরাচর তাদের চোখে দেখি না, তাদের ডাক শুনি না, আকারে খুব ছোট এবং চোখে পড়ার মতো বাহারি রঙের নয় এমন আরও নিযুত পাখি আমাদের ঘরদোর, উঠান, বাগান, ফসলের খেত ও খামার, ঝোপঝাড়, নলখাগড়া-হোগলা-বেত-পাটিবেতের বন, সব প্রাকৃতিক বন, উপবন ও খণ্ড বন এবং শহর-বন্দর-গ্রামের ওপর দিয়ে পার হয়। যেকোনো বিমান, উড়োজাহাজ আকাশে এবং সাগরে-সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ যেমন নিজের খেয়াল-খুশিমতো পথ বেছে নিতে পারে না, দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক নানা রীতিনীতি মেনে নির্দিষ্ট পথে চলতে হয়; তেমনি পরিযায়ী পাখিরা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে বিশ্বব্যাপী প্রধানত আটটি আকাশপথ ব্যবহার করে চলে। এসব পথকে বলা হয় পাখির পরিযায়নের উড়াল বা উড়ালপথ, যার তিনটি পড়েছে এশিয়া মহাদেশে। বলা যায় প্রায় বাংলাদেশেই। এই তিনটির দুটির প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশ অবস্থিত।
পাখিরা, বিশেষ করে পরিযায়ী হাঁস—রাজহাঁস, সারস, মানিকজোড়, জলচর ও জলাভূমির পাখিরা বা ওয়েডার্সরা—গেল বহু সহস্র বছর ধরে এই আটটি পথ এবং তাদের অধীনে আরও বেশ কিছু উপ-উড়ালপথ ব্যবহার করে মূলত শীতপ্রধান, বরফাবৃত উত্তর মেরু ও এর আশপাশের দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত পাখি ও পরিবেশবান্ধব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং কর্কট ও মকর ক্রান্তির মাঝখানের বৈশ্বিক অঞ্চলে পরিযায়ন করে আসছে। প্রধানত শীতের সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং বসন্তে বা তার শেষে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে ধাবিত হয় এসব পরিযায়ী পাখি। তারা এ দুই দিকে চলার সময় নিজস্ব উড়ালপথ ব্যবহার করে। এসব পথ মূলত সোজাসুজি সাগর পার হওয়া, উপকূলীয় এলাকা অনুসরণ করা বা বিভিন্ন মহাদেশের অনুকূল ভূমিবৈচিত্র্যের রূপরেখা ধরে চলা।
আমাদের দেশে যে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে, তার মধ্যে ৫৩টি প্রজাতি আইইউসিএনের বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় বা রেড ডেটাবুকে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে আছে চারটি মহাবিপন্ন বা ক্রিটিক্যালি এনডেনজারড, সাতটি বিপন্ন বা এনডেনজারড, ২০টি সংকটাপন্ন বা ভালনারেবল এবং ২২টি প্রায় সংকটাপন্ন বা নিয়ার থ্রেটেন্ড প্রজাতি। এর বাইরেও অনেক প্রজাতি আমাদের মিঠা ও লোনাপানির জলাভূমিতে পরিযায়ন করে। এর মধ্যে রয়েছে সুদূর সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়া, হিমালয়ের পাদদেশ, চীন-তিব্বত ও মিয়ানমার থেকে আসা বহু প্রজাতি।
বিপন্ন প্রজাতিগুলোর মধ্যে আমাদের দেশে প্রধান পরিযায়ীদের ভেতরে আছে পানিকাটা, জলখোর বা পানিচরা (Rhynchops albicollis); কাস্তেচরা (Treskeornis melanocephala)। এদের বড় দল পরিযায়ী, ছোট দল স্থানীয়। হাড়গিলা (L.dubius), বৈকাল হাঁস (Anas formosa), বড় ভূঁতিহাঁস (Aythya baeri), ভূঁতিহাঁস Ferruginous Pochard (Aythya ferina), পাহাড়ি চাহা (Gallinago nemoricola), তিলা-সবুজ চাপাখি (Tringa guttifer) এবং কোদালঠোঁটি চাপাখি (Eurynorynchus pygmeus)। সবচেয়ে দূরপাল্লার পাখির মধ্যে আছে বড় গুলিন্দা (Numenius arquata orientalis), ছোট গুলিন্দা (Numenius phaeopus), কালোলেজ জৌরালি (Limosa limosa), ডোরালেজ জৌরালি (Limosa Lapponica) এবং টেমিনকের চাপাখি (Calidris temminckii)।

বাংলাদেশ পরিযায়ী পাখিদের কেন্দ্র
বাংলাদেশে যে পরিমাণ মোহনাঞ্চল ও মিঠাপানির জলাভূমি এখনো বিদ্যমান তা প্রচুর পরিমাণে পরিযায়ী আকর্ষণ করে। এর কারণ অনেক।
কমপক্ষে গেলো ১০ হাজার বছর আগে, মানে সর্বশেষ মহাহিমবাহ যুগের পরে, পরিযায়ী পাখিরা অন্তত দুটি—মধ্য এশিয়া-ভারতীয় এবং পূর্ব এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া—উড়ালপথ ব্যবহার করে আমাদের দেশে ও কাছাকাছি ভারতীয় ও মিয়ানমার অংশে প্রতিবছর আসে ও শীত শেষে আবার ফিরে যায়। অতএব, পাখিরা তাদের সহজাত প্রবণতা হিসেবে শীত বা অন্য ঋতুতে আমাদের জলাভূমি অঞ্চলে আসে।
মিঠাপানি ও লোনাপানির জলাভূমিকে বলা হয় ‘জীববৈজ্ঞানিক সুপারমার্কেট’। অর্থাৎ এখানে বসবাসকারী পাখি ও অন্য সব প্রাণী এবং এমন এলাকায় পরিযায়ন করে আসা পাখিরা উপভোগ করে নিরাপদ ও শত্রুমুক্ত আশ্রয়স্থল, অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং উদ্ভিদের এক ধরনের মিশ্রণ। এর মধ্যে থাকে কেঁচো, চিংড়ি-কাঁকড়া, জলজ পোকামাকড়, শামুক-ঝিনুক, মাছ ও তার পোনা, ব্যাঙ ও ব্যাঙাচি, সরীসৃপ, পাখি, ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, প্রাণীকণা বা জ্যুপ্ল্যাঙ্কটন, শেওলা, শৈবাল, ঝাঙ্গি, পানি ঢেঁকিশাক, কলমিলতা, লজ্জাবতী লতা, শাপলা-শালুক-পদ্ম, মাকনা, নিকনাই বা তিনকাটা পানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদকণা বা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন।
জলাভূমির কাদাময় বা বালুবেলা অংশে বসবাস করে অযুত-নিযুত মিঠাপানির বা সামুদ্রিক প্রাণীর শুককীট, কেঁচোজাতীয় প্রাণী, খোলসী ও অখোলসী কম্বোজ। এ ছাড়া এখানে এক চিমটি চিংড়ি-কাঁকড়া থেকে মাছের পোনার বাস যা খাবার জন্য পরিযায়ী পাখিদের সবচেয়ে বড় দল মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলে ভিড় করে।
জলাভূমির ভেতরে বা আশপাশে হিজল, তমাল, করচ বা করনজ, বরুনা, পিটালী, শিমুল, দেবদারু, গাব, জিকা প্রভৃতি বড় বড় গাছ থাকার ফলে অনেক পরিযায়ী পাখি সারা দিন বা সারা রাত জলজ প্রাণী-উদ্ভিদ খাওয়ার পর বিশ্রাম নেয় বা ঘুমায় ওই সব গাছে। এই গাছপালা তাদের শত্রুর হাত থেকেও রক্ষা করে।
এ ছাড়া চোরা শিকারি, বড় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পাখি ধরা এবং শখের শিকারিদের সংখ্যা আশপাশের বহু দেশের চেয়ে আমাদের দেশে কম।
লেখক  দুবাই জাদুঘরপ্রধান।
 সুত্র: প্রথম আলো
 রেজা খান | তারিখ: ২১-০৫-২০১০

No comments: